এক চোখ হারিয়েছেন, আরেক চোখও ঝুঁকিতে আমিনুলের

গত বছরের ১৮ জুলাই। সন্ধ্যার পরই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল সড়কবাতি। দোকানপাটও বন্ধ। এর মধ্যেই শুরু হলো লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস আর ছররার গুলিবর্ষণ। আতঙ্কে ছোটাছুটি, চিৎকারে ভরে ওঠে পুরো এলাকা। সেই ভয়াল সন্ধ্যায় কক্সবাজারের হাসপাতাল সড়কে ছররা গুলিতে আহত হন আমিনুল ইসলাম।

আমিনুল কক্সবাজার সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে ডান চোখে ছররা গুলি লাগে তাঁর। এরপর হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছেন তিনি। করিয়েছেন একে একে পাঁচবার অস্ত্রোপচার। কিন্তু চোখ আর ফেরেনি। চিকিৎসকেরা বলছেন, অপর চোখটিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন পুরোপুরি দৃষ্টিহীন হয়ে পড়বেন তিনি।

গত শনিবার দুপুরে কক্সবাজার শহরের খুরুশকুল সড়কের পাশে বাঁকখালী নদীর তীরে একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে কথাগুলো বলছিলেন আমিনুল। তাঁর চোখজোড়া তখন সানগ্লাসে ঢাকা। অনেকটা কষ্ট নিয়েই তিনি প্রথম আলোকে বলেন,‘ডান চোখে তো কিছুই দেখি না। এখন বাঁ চোখও ঝুঁকিতে।’

সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিকেলে লিংকরোড থেকে মিছিলটি শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল অতিক্রম করে মিছিল পৌঁছায় শহরের পানবাজার সড়কের পেট্রলপাম্প এলাকায়। সন্ধ্যা ছয়টা দিকে নিভিয়ে দেওয়া হয় সড়কের বাতি। তারপরই শুরু হয় ছররা গুলি। সেই গুলিতেই আহত হই। স্থানীয়রা উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।’

আমিনুল বলেন, তাঁর চোখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ছররার অন্তত ১৬টি গুলির দাগ ছিল। ১৯ জুলাই চিকিৎসক তাঁকে চট্টগ্রাম পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পরে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল—এই যাত্রাপথে কেটেছে কয়েক দিন। এরপর ঢাকার একটি চক্ষু হাসপাতালে চারবার অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু কোনোটাই কাজে আসেনি। ছররার কিছু কণা এখনো রয়ে গেছে চোখের ভেতর। সেটিই এখন অপর চোখের জন্য হুমকি।

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে আমিনুল বলেন, চোখটি রক্ষা করতে হলে দ্রুত উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু সেটি দেশের বাইরে ছাড়া সম্ভব নয়। এ কারণে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা দরকার। পরিবারে এমন সামর্থ্য নেই। বাবা নুরুল আমিন একজন কাপড় বিক্রেতা। শহরের পানবাজার সড়কের হকার্স মার্কেটে একটি ছোট দোকান চালান। চার ভাই ও এক বোনের সংসারে আমিনুল বড়। পরিবারের বেশির ভাগ ব্যয়ই চলে তাঁর বাবার দোকানের আয়ে।

আমিনুল বলেন, এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় ৪ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ১৫ হাজার টাকা, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন দুই দফায় ৩ লাখ, সমাজসেবা দপ্তর থেকে ৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। আন্দোলনের সময় হওয়া আহতদের সরকারি তালিকাতেও নেই তাঁর নাম।

জীবন এত কঠিন হবে, জানতাম না

নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে আমিনুল বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের লোক ছিলাম না। রাজনীতিও করিনি। শুধু চেয়েছিলাম, একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। সেই ভালোবাসার দাম দিলাম চোখ দিয়ে। এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জীবন এত কঠিন হবে, জানতাম না। একা একা ঢাকায় যাই চিকিৎসা করাতে। কারও সাড়া পাই না। আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের কেউ আসেন না। অনেকে দেখতেও চান না।’

জানতে চাইলে বাবা নুরুল আমিন বলেন, ‘আন্দোলনের এক বছর পার হলেও আমার ছেলের চোখের চিকিৎসায় সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছি না। বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্যও আমার নেই। চোখ হারিয়ে মেধাবী ছেলেটার জীবন এভাবে যাবে, ভাবতেও কষ্ট হয়।’

এদিকে এক চোখ হারালেও আমিনুলের নাম সরকারিভাবে করা আহতদের তালিকায় নেই। জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কক্সবাজারের আহ্বায়ক সাহেদুল ওয়াহিদ বলেন, ‘তিনি (আমিনুল) আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে আহত হয়েছেন। তাঁকে সরকারি সাহায্য দিতে কেন্দ্রে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’

Related Posts

About The Author