ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাসিরনগরে ছাত্রদল নেতার মৃত্যুর জেরে ৪০ বাড়িঘরে হামলা-লুটপাট, গ্রামছাড়া শতাধিক পরিবার

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতার মৃত্যুর পর প্রতিপক্ষের অন্তত ৪০টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পর গ্রেপ্তার ও প্রতিপক্ষের হামলা এড়াতে শতাধিক পরিবারের লোকজন গ্রামছাড়া।

গত শনিবার দুপুরে উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উল্টা গোষ্ঠী ও মোল্লা গোষ্ঠীর পক্ষের সংঘর্ষে মোল্লা গোষ্ঠী পক্ষের ছাত্রদল নেতা সোহরাব মিয়া (২৮) নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন। নিহত সোহরাব মিয়া চাতলপাড় ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ও কাঁঠালকান্দি ওয়ার্ড (৯ নম্বর) ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাতলপাড় ইউনিয়নের উল্টা গোষ্ঠী ও মোল্লা গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। উল্টা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন চাতলপাড় ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক গিয়াস উদ্দিন। মোল্লা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন কাঁঠালকান্দি ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আল আমিন ও ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি মোতাহার হোসেন। গত শনিবার দুপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ওই ঘটনায় ছাত্রদল নেতা সোহরাব নিহত হওয়ার পর তাঁর ভাই মোজাহিদ মিয়া বাদী হয়ে ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন, ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি মো. আফসর মিয়া, ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি শরীফ মিয়া ও জাকারিয়া আহমেদ, কৃষক দলের সদস্যসচিব সিরাজুল ইসলামসহ ৬০ জনকে আসামি করে থানায় একটি এজাহার জমা দেন।

এ ঘটনার পর প্রতিপক্ষ উল্টা গোষ্ঠীর ৪০টি বাড়িঘর, চাতলপাড় বাজারের চালের আড়ত, মোবাইল ও বিকাশের দোকান, রড-সিমেন্টের দোকান, সিঙ্গার রেফ্রিজারেটরের একটি শোরুমসহ ছয়টি দোকানে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। ১০টি গরু ও কৃষকের গোলা থেকে প্রায় এক হাজার মণ ধানও নিয়ে যায়। ভুক্তভোগীদের দাবি, চাতলপাড় বাজারের ছয়টি দোকান থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার মালামাল লুট করা হয়।

বিদ্যালয়ে কমেছে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি

এদিকে ছাত্রদল নেতার মৃত্যুর পর গ্রামের কাঁঠালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে। অধ্যয়নরত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় তিন শ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। কয়েকজন শিক্ষকও ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে গেছেন। বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনা করে। সংঘর্ষ ও ছাত্রদল নেতার মৃত্যুর ঘটনার পর ভয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২১ শিক্ষার্থী প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিনা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষকেরাও আতঙ্কে আছেন। তিন শতাধিক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসেনি। মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। অভিভাবকদের কাছে ফোন করেও সাড়া মেলেনি। যেসব অভিভাবক এলাকা ছেড়েছেন, তাঁদের সন্তানেরা বিদ্যালয়ে আসছে না।

ষাটোর্ধ্ব মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করি নাই। তারপরও আমার বাড়িতে মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন হামলা ও ভাঙচুর করে সব নিয়ে গেছে। এর পর থেকে জমিতে ঘুমাই। তিন দিন ধরে ঘরে খাবার ও পানি নেই। হামলাকারীরা ঘরের চুলা ও টিউবওয়েলটিও তুলে নিয়ে গেছে।’

সাফিয়া বেগম নামের এক গৃহিণী বলেন, অসুস্থতার কারণে তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন ধরে বিছানায়। গ্রামের একটি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে একটি ঘর বানিয়েছিলেন। মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন সেই ঘরটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।

চাতলপাড় বাজারের ব্যবসায়ী মো. হামজা বলেন, ‘আমার দোকানে থাকা ২৫ লাখ টাকা ও রড-সিমেন্টের দোকানের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। আমার সব শেষ।’

যুবদল নেতা গিয়াস উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন তাঁদের ৪০টির বেশি ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। পাঁচজনের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের হামলা থেকে স্থানীয় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও জাসাসের নেতাদের বাড়িঘরও রক্ষা পায়নি।

অন্যদিকে নিহত সোহরাবের বাড়িতে মাতম চলছে। নিহত ব্যক্তির ভাই মোজাহিদ মিয়া বলেন, তিনি ভাইয়ের হত্যার বিচার চান। প্রতিপক্ষের বাড়িতে তাঁরা হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে জড়িত না বলে দাবি করেন।

চাতলপাড় পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, উল্টা গোষ্ঠীর ১০-১২টি বাড়িঘর পরিদর্শন করে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের তথ্য পেয়েছেন। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। নিহত ব্যক্তির পরিবার একটি এজাহার জমা দিয়েছে। আসামিদের পরিচয় যাচাই চলছে। মামলাটি প্রক্রিয়াধীন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। যাতায়াতের সুবিধা নেই। তাই আমাদের ওই এলাকায় যাওয়া অনেকটা কঠিন।’

Related Posts

About The Author