বিশেষ প্রতিবেদন: নিজস্ব প্রতিবেদক
“ভাবিনি দালালের হাত ধরে রাশিয়া পাড়ি দিয়ে একদিন ইউক্রেনের মাটিতে অস্ত্র হাতে দাঁড়াতে হবে।”
বিস্ময়, হতাশা, আতঙ্ক আর বেঁচে ফেরার আকুতি—এভাবেই নিজেদের গল্প বললেন রুশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়া কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণ। ইউক্রেন যুদ্ধের বিভীষিকায় জড়িয়ে পড়া তাঁদের জীবন কাহিনি যেন সিনেমার চিত্রনাট্য। তবে এ গল্প বাস্তব, আর এতে আছে ভয়াবহ প্রতারণা, মানবপাচার আর রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তার করুণ ছবি।
শুরুটা ছিল ‘ভবিষ্যতের স্বপ্ন’ দিয়ে
আশুগঞ্জের মোহাম্মদ আকরাম মিয়া, ময়মনসিংহের ইয়াসিন মিয়া শেখ, গোপালপুরের আফজাল হোসেন মেরাজ, গাজীপুরের অয়ন মণ্ডলসহ অন্তত ৪০-৫০ জন বাংলাদেশি তরুণ ইউরোপে ভালো কাজের আশায় রাশিয়া যান। উদ্দেশ্য ছিল উত্তর মেসিডোনিয়া, জার্মানি বা কোনো পশ্চিমা দেশ। কিন্তু পথে হাতবদল করে দেন দালালরা।
প্রথমে রাশিয়ার একটি কোম্পানিতে কাজ—ইলেকট্রিশিয়ান, ওয়েল্ডার বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বেতন ৪০-৭০ হাজার রুবল। কিন্তু কাজ শুরু করার দুই-তিন মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের ছাঁটাই করে দেয়। তখনই শুরু হয় ভয়াবহ ফাঁদে পড়ার যাত্রা।
বিমানবন্দর থেকে সরাসরি দালালের জালে
দেশে ফেরার জন্য রুশ বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই তাঁদের তুলে নেয় একাধিক দালালচক্র। হোটেলে নিয়ে ভিসা নবায়নের কথা বলে তাঁদের পাসপোর্ট, কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর চুক্তিনামায় স্বাক্ষর—যার মানে ছিল, তাঁরা এখন ‘চুক্তিভিত্তিক সেনা’।
একজন ভুক্তভোগী জানান, “আমাদের জঙ্গলে গাছ কাটাতে পাঠানো হয়। কয়েকদিন পর দেখি বন্দুক আর গোলাবারুদ আনা হচ্ছে। আমরা বুঝি, আমাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।”
সামান্য প্রশিক্ষণ, তারপর যুদ্ধের ময়দানে
শুধু ৩-৫ দিনের হালকা অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দিয়েই পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে। মিসাইল হামলা, ড্রোন আক্রমণ, ফ্রন্টলাইন থেকে ফেরা—সবই এখন এই তরুণদের বাস্তবতা। এদের অনেকেই নিখোঁজ, অনেকে মৃত্যুর কোলে।
আকরাম মিয়া, ইয়াসিন শেখ—তাঁরা আর ফেরেননি। জীবনের বিনিময়ে হয়তো পাওয়া হয়েছে রুশ বাহিনীর একটি নম্বর।
অস্ত্রধারী বাঙালি যুবকের কান্না
রাশিয়ার সেনাশিবির থেকে পাঠানো ভয়েস রেকর্ডে অয়ন মণ্ডল জানান, “আমরা ফোনে কথা বলতে পারি না। লুকিয়ে ফোন চালাই। খুব বিপদের মধ্যে আছি।”
একই সুরে আফজাল হোসেন বলেন, “এখনো বেতন পাইনি। কিসের নাগরিকত্ব, কিসের চাকরি! মৃত্যুর অপেক্ষা করছি শুধু।”
তাঁদের অভিযোগ, বাংলাদেশি দালালেরাই মূল ফাঁদে ফেলেছে। লাখ লাখ টাকা নিয়ে রাশিয়ায় পাঠানোর নামে তাঁদের পাচার করে দেওয়া হয়েছে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে।
সরকার কি শুনছে?
এই তরুণরা বাংলাদেশের সরকার ও দূতাবাসের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন—তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনতে যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তাঁদের বক্তব্য, “যাঁরা এখনো রাশিয়ায় আসার পরিকল্পনা করছেন, অনুরোধ করছি—থামুন। আমরা যে দুঃস্বপ্নে আটকে আছি, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না।”