নিজস্ব প্রতিবেদক, মোঃ সাইফুল আলম – আখাউড়া ডট কম
তিতাসবিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। শুধু সাংস্কৃতিক বিষয়ই না, শিক্ষা, ধর্ম, বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও পর্যটন শিল্প সব দিক থেকেই এগিয়ে রয়েছে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। আর একটি জাতীয় শ্রেষ্ঠ বিষয় জড়িয়ে রয়েছে এই জেলাকে ঘিরে। সেটি হল আখাউড়ায় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আর এই অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশের ইতিহাসের সোনালি অক্ষরে যে ৭ জন বীর শ্রেষ্ঠ গাঁথা আছে তার একজন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের দরুইন গ্রামে রয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ এই সন্তানের।
সারাদেশের নানান প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন এই দরুইন গ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি দেখতে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনেক মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসে এখানে। অনেক জেলা থেকে আগত মানুষ চোখে পড়ে এই সমাধিতে। উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনির হোসেন বলেন, এটা সত্যিই আমাদের জন্য একটি সম্পদ। আমাদের এলাকার জন্য গৌরবের এই বিষয়। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টি; বিশেষ করে ছানামুখি ও রসমালাই খেতে যতটা না গর্ববোধ কি তার থেকেও অধিক গর্ববোধ করি এই সমাধি নিয়ে।
আখাউড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মো.জুয়েল মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক অমিত হাসান আবির সহ সব সেক্টরের সাংবাদিকদের চোখে এই বীরশ্রেষ্ঠ’র সমাধি এক রত্ন ও গর্বের স্থান। তারা ইতিহাস পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালে সরকার সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নে মৌটুপি গ্রামে কিছু সম্পত্তিসহ তার-পিতা-মাতার জন্য একটি পাকা বাসভবন নির্মাণ করে তাদের পুনর্বাসিত করে। বর্তমানে এ গ্রামের নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল নগর রাখা হয়েছে। এ গ্রামের বাড়িতেই বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মা মালেকা বেগমসহ পরিবারের অন্যন্য সদস্যরা বসবাস করেন। বাড়ির পাশেই ২০০৮ সালে সরকারিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’।
মোস্তফা কামালের ছোট বেলা থেকেই স্কুলের পড়ালেখার চেয়ে ভালো লাগত সৈনিকদের কুচকাওয়াজ। নিজেও স্বপ্ন দেখেন একদিন সৈনিক হওয়ার। ১৯৬৭ সালে কাউকে কিছু না বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ক্রমশই স্বাধীনতার দাবিতে সারা দেশ উত্তাল হতে থাকে। ৭মার্চ জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে বীরদর্পে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মোস্তফা কামাল।সিপাহী মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল ১টি মুক্তিযোদ্ধাদের দল ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে আসা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ঠেকানোর জন্য আখাউড়ার দরুইন গ্রামে অবস্থান নেয়। সংখ্যায় বেশি ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকা-বাহিনীর সাথে মোকাবেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল অদম্য মনোবল। প্রচন্ড ঝুঁকির মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর জন্য প্রস্তত থাকে অস্ত্র হাতে। এপ্রিল সকাল থেকেই আকাশে মেঘ ছিল। সকাল ১১টার দিকে শুরু হয় প্রচন্ড বৃষ্টি। একইসাথে শত্রুর গোলাবর্ষণ। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি করতে শুরু করলো। শুরু হলো সম্মুখ যুদ্ধ। মেশিনগান চালানো অবস্থায় এক মুক্তিযোদ্ধার বুকে গুলি লাগে। মুহূর্তের মধ্যে মোস্তফা কামাল এগিয়ে এসে চালাতে লাগলেন মেশিনগান। গর্জন করে উঠে তার হাতের অস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কোন অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল না। সংখায়ও অনেক কম ছিলো তারা। আর পাকিস্থানী সৈন্যরা সংখায় ছিল অনেক বেশি ও ভারি অস্ত্র শস্ত্র সজ্জিত তারা। হয় সামনা সামনি যুদ্ধ করে মরতে হবে, নয় পিছু হটতে হবে। কিন্তু পিছু হটতে হলেও সময় দরকার। ততক্ষণ অবিরাম গুলি চালিয়ে শত্রুদের আটকিয়ে রাখতে হবে। কে নেবে এই মহান দায়িত্ব?
এমন সময় আরো একজন মুক্তিযোদ্ধার বুকে গুলি বিঁধে। ততক্ষণে মোস্তফা কামাল সকল সহযোদ্ধাকে সরে যেতে বলেন। পরিখার মধ্যে সোজা হয়ে চালাতে লাগলেন স্টেনগান। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ছেড়ে যেতে না চাইলে তিনি আবারো সবাইকে নিরাপদে যেতে বলেন। অবিরাম গুলি চালাতে থাকেন তিনি। তার গোলাবর্ষণে শত্রুদের থমকে যেতে হয়েছে। মারা পড়েছে বেশ কয়েকজন পাক সৈন্য।
ততক্ষণে দলের অন্য সদস্যরা নিরাপদে পিছু হটেছেন। একসময় মোস্তফা কামালের গুলি শেষ হয়ে যায়। হঠাৎ করেই একটি গুলি এসে লাগে তার বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। মারা যান মোস্তফা কামাল। তার এমন বীরত্বের কারণে সহযোদ্ধাদের প্রাণ রক্ষা পায়।জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানকে দরুইনের মাটিতে সমাহিত করা হয়। অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ প্রদান করে বাংলাদেশ সরকার।
সমাধিস্থল যাবার সহজ রাস্তা ও খরচ:
ঢাকা থেকে ট্রেনে আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন আসতে পারেন। ট্রেন ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ৭০ থেকে ২৬৫ টাকা। আবার আপনি ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে বা বাসে করে আসতে পারেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়ার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। আখাউড়া থেকে দরুইন গ্রামের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। আপনি ব্যক্তিগত গাড়ি বা লোকাল পরিবহনে আসতে পারবেন এই সমাধিতে। আর যদি থেকে যেতে চান তাহলে আখাউড়া উপজেলায় বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কিছু আবাসিক হোটেল পাবেন অল্প খরচে থাকতে পারবেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক।