নবীনগর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা

নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম

মেঘনা-তিতাস বিধৌত ঐতিহ্যের সৌরভে আর গৌরবে অনন্য নবীনগর। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার (নবীনগর উপজেলা) একসময়ের একটি প্রাচীন জনপদ। বৌদ্ধ শাসনামলে এই এলাকা ছিল সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। পরে সোনার গায়ের মুসলিম শাসকদের অধীনস্থ হয়। মুসলিম শাসনকালে ৩টি পরগনায় বিভক্ত ছিল বর্তমান নবীনগর উপজেলা। নবীনগর হতে দক্ষিণ মুখী প্রবাহিত বুড়িনদীর (তিতাস নদীর শাখা) পশ্চিম অংশ ছিল রবদাখাত পরগনার্ভুক্ত, পূর্বাঞ্চলের ০৫টি ইউনিয়ন (বুড়ি নদীর পূর্বে) ত্রিপুরা রাজ্যের চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলের নূরনগর পরগনা হিসেবে এবং উত্তর দিকের মেঘনা-তিতাস-পাগলা নদী তীরবর্তী গ্রামগুলিকে শাহবাজপুর জনপদের সরাইল পরগনার আওতাধীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইংরেজ শাসনামলে ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ভারতবর্ষের প্রথম ম্যাপ রোনাল্ড রে প্রণীত মানচিত্রে নবীনগরকে খুব গুরুত্বের সাথে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, মলয়া গানের সাধক কবি মহর্ষি মনোমোহন দত্তের জন্মভুমি এ উর্বর পলিমাটি। প্রাচীন কালের কালীদহ সায়র (সাগর) এর উত্তর প্রমত্তা সীমার হাজার বছরের বিবর্তণে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের একাংশ-ই আজকের নবীনগর উপজেলা।

নাটঘর গ্রাম থেকে উদ্ধার হওয়া সপ্তম শতাব্দীর শিবমূর্তি, বাঘাউড়া গ্রামের সপ্তম শতাব্দীর কস্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তি (কলিকাতা যাদুঘরে সংরক্ষিত), সাতমোড় গ্রাম থেকে উদ্ধারকৃত সপ্তম শতাব্দীর কস্টিপাথরের বিষ্ণু মূতি (ঢাকা জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত), শাহপুর গ্রামের মসজিদ, (১৮৭৬ খ্রি:), বিদ্যাকুট গ্রামের সতীদাহ স্মৃতি মন্দির, মুন্সেফ আদালত (১৮৮৪) নবীনগর, বিটঘর, কাইতলা, কৃষ্ণনগর গ্রামের প্রাচীন জমিদার বাড়িসহ রতনপুর গ্রামের দারোগাবাড়ির বিলুপ্তপ্রায় ভবনটি নবীনগর উপজেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।

নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, ১৮৭৫ সালে প্রথম নবীনগর থানা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। একই সময়ে রছুল্লাবাদ গ্রামেও একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল বলে জানা যায়। ১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিলের কলিকাতা গেজেটের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে রছুল্লাবাদ ফাঁড়িটি বিলুপ্তি হয়। ঐ সময় মোট ২৩৪ টি গ্রাম নিয়ে নবীনগর থানা পুনর্গঠিত হয়।

নবীনগর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা

১৮৮৩ সালে নবীনগরে প্রথম মুন্সেফ আদালত চালু হয়। ১৯৮৩ সালের ২৪মার্চ নবীনগর থানাকে আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। এই উপজেলাটি ১৬১টি মৌজা, ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা ২৪৬ (ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ৫)- এর অধীন। পরবর্তী সময় ১৯৯৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উপজেলা সদর সহ পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে নবীনগর পৌরসভা গঠন করা হয়। বর্তমানে নবীনগর পৌরসভা ১ম শ্রেণির পৌরসভার মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সূর্য সন্তানদের কথা

নবীনগর উপজেলার নামকরণঃ

নবীনগর একটি প্রাচীন জনপদ। তাই এ জনপদের নামকরণও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নবীনগর নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে একাধিক ভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।

প্রথম ধারার জনশ্রুতি:

  • প্রাচীনকালের জনৈক নবীন চন্দ্র নামক রাজার নামানুসারে নবীন এবং গড় শব্দের অপভ্রংশ (গড়>গর) থেকে নবীনগর নামকরণ হয়েছে।
  • [কিন্তু এ এলাকার প্রাচীন ইতিহাসে নবীন চন্দ্র নামে কোন রাজা এমনকি জমিদারেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে এ জনশ্রুতি মেনে নেয়া যায় না।]

দ্বিতীয় ধারার জনশ্রুতি:

  • কেউ কেউ বলেন, নবীর নামে এই নবীনগর। অনেকেই দাবি করেন, মুসলিম শাসনামলে ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন মুসলমানদের নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ‘নবী’ এবং নগর দুটি শব্দের সংমিশ্রণে নবীনগর নামকরণ করা হয়েছে।
  • [তবে এখানে কোনো নবী না এলেও অসংখ্য সুফি আউলিয়ার পদচারণা ছিল। কালের সাক্ষ্য হিসেবে উপজেলার পূর্বপাশে ‘বার আউলিয়ার বিল’ এখনাে দৃশ্যমান আছে। ফলে সুফি – আউলিয়াদের দ্বারাও এ অঞ্চলের আবাদ হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সূফি দরবেশ হযরত শাহজালাল (১২৭১ – ১৩৪১) রাহ: ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজী সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। হযরত শাহজালাল (র:) ও তার সফরসঙ্গী ওলী আউলিয়ারা এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে নদীপথে সিলেট যান বলে জনশ্রুতি আছে। ধারনা করা হচ্ছে, তাঁরা সে সময় যাত্রা বিরতি করে ইসলাম ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে কিছুকাল অবস্থান করেন। বরকন্দাজ তাউলিয়া, শেখ সাদী সফী, ছানাউল্লাহ (রঃ) প্রমুখ আধ্যাত্মিক পুরুষের প্রভাব এ অঞ্চলে অস্বীকার করা যায় না। নদী তীরবর্তী নাসিরাবাদ, শাহবাজপুর, নবীনগরসহ বিভিন্ন গ্রামের ইসলামী নামকরণের প্রবনতা দ্বিতীয় জনমতকেই জোরালো করে।]

তৃতীয় ধারার জনশ্রুতি:

  • বিখ্যাত ভূমি জরিপকারী জেমস রেনেলের (১৭৬৪- ৭৬ ) মানচিত্রে বলদাখাল পরগনা, নূরনগর পরগনাসহ এই অঞ্চলের কিছু কিছু গ্রামের নাম পাওয়া যায়। কিংবদন্তি আছে, ১০৫০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সরাইল, দাউদপুর, নূরনগর ও বলদাখাল পরগনা কালিদহ সাগরের অংশবিশেষ ছিল।
  • [চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা বা সওদাগরি জাহাজ এই কালিদহ সাগর দিয়ে সিলেট ও ময়মনসিংহের বাণিজ্যিক এলাকায় পণ্যসম্ভার ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যস্ত ছিল।]
  • এই অঞ্চলটি কালিদহ সাগরের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে চর জেগে বহুকাল ধরে একটি বসতি স্থাপনের যােগ্য হয়েছে। সে সময় পাটিকারা, গঙ্গামণ্ডল, লৌহগড়া ও চান্দিনার সমতলভূমি আবাসযােগ্য ও জনবসতিপূর্ণ ছিল। সেক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে বড় এলাকা। সে হিসেবে ‘নবীন’ ও ‘গড়‘ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে পরবর্তীকালে লােকমুখে উচ্চারিত হয়েছে নবীনগর। এ রূপান্তর হওয়ার বিষয়টি অমূলক নয় বলে মনে হয় ।

চতুর্থ ধারার জনশ্রুতি:

  • ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে নবীনগরের শিবপুরে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তির নামফলকের ইতিহাস থেকে অবগত হওয়া যায় যে, (৯৮৮ – ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ) এই অঞ্চলে সমতট রাজ্যের শ্রী মহিপাল দেবের রাজত্ব ছিল। শ্ৰী মহিপাল এর রাজত্বের পরই এই এলাকায় শ্রী নবীনপাল দেব নামে এক পাল বংশীয় শাসকের জনশ্রুতি রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ঐ শাসকের নামানুসারেই এ অঞ্চলটি হলাে নবীনপাল দেব এর এলাকা বা নবীনগর যা। পরবর্তী পর্যায়ে আধুনিক নবীনগর।

পঞ্চম ধারার জনশ্রুতি:

  • নবীনগর নামকরণ ব্যাপারে আরও একটি তথ্য পরিবেশন করা হয়, ঈদ–ই মিলাদুন্নবীর দিনে এ অঞ্চলে নতুন শাসকের উদ্ভবের সুবাদে এ অঞ্চলটির নামকরণ হয় নবীনগর। বলা হয়, এই অঞ্চলের হিন্দুত্ববাদের পতন ঘটিয়ে মুসলিম বীর সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি (আফগানিস্তানে জন্ম, সাল অজানা- মৃত্য ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) উত্তর বাংলা বিজয়ের পর এ অঞ্চলে সেনাপতি প্রেরণ করেন এবং কোনাে এক মুসলিম শাসক এসে নবীনগর এর সৃষ্টি করেন। সম্প্রতি নবীনগর শব্দের বানান রীতিতেও নবিনগর ‘ । “ ই ‘ কার এর পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে গবেষণার দাবি রাখে।

ষষ্ঠ ধারার জনশ্রুতি:

  • নানা মহলে এও জনশ্রুতি আছে যে, বলদাখাল বা বরদাখাত পরগনার জমিদার বেগম রওশন আরার কর্মচারী সীতারাম পােদ্দার ওই জমিদারির এক অংশ ক্রয় করে নবীনগরের গােড়াপত্তনে সচেষ্ট হন বিধায় তারই বংশধর নবীন পােদ্দার – এর নাম থেকে নবীনগর নামকরণ করা হয়েছে।

সপ্তম ধারার জনশ্রুতি:

  • কথিত আছে, অতীতে এই অঞ্চল নদীগর্ভে বিলীন ছিল। পরবর্তীতে পলি জমে এখানে চর পড়ে। কিছু সংখ্যক লোক এখানে এসে বসতি স্থাপনের জন্য নতুন নতুন ঘর (অর্থাৎ নবীন ঘর) নির্মাণ করে। এই নবীন ঘরই কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান নবীনগর নামের উৎপত্তি।

অষ্টম ধারার জনশ্রুতি:

  • আবার বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এই চরে প্রথমে বসতি স্থাপন করলে তারা নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র নামানুসারে এই জনপদের নাম রাখেন নবীনগর। তুলনামূলকভাবে এ ধারার জনশ্রুতির সত্যতার স্বপক্ষে বেশী লোকের মতামত পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ইতিকথা -এস এম শাহনূর

লেখক: এস এম শাহনূর
কবি, মুক্তিযুদ্ধ, লোকজন সংস্কৃতি ও ইতিহাস গবেষক।

Related Posts

About The Author

Add Comment