নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান কলি থেকে ফুল হতেই অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, “বঙ্গ মাগো তোমার আঁচলে আমি সোনার হরিণ জড়াবো।” বড় হয়ে ঠিক তাই করেছিলেন তিনি। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য শত অত্যাচার নির্যাতন ও জেল জুলুম সয়েছেন। কারাবরণ করতে হয়েছে বহুবার। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তী সময়ে যার নাম হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে সংবর্ধনা সভায় তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে ঘোষণা দেন। সেই থেকে তিনি বাঙালির বঙ্গবন্ধু।
যুগে যুগে সারা পৃথিবীর স্বাধিকার আন্দোলনে কোনো একটি বা কয়েকটি নির্দিষ্ট স্লোগান সেই লড়াই-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই এই বাংলার পুরো জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা তথা তাদের স্বাধিকারের পথে নিয়ে যেতে একটি অভিন্ন স্লোগানের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের শেষে ‘জয় বাংলা’ বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে এটি পারমানবিক বোমার মত রণধ্বনি হিসাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। চাই মুক্তি, চাই স্বাধীনতা। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস একটি সশস্ত্র যুদ্ধ, ত্রিশলক্ষ তাজা প্রাণ, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়—
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?’
‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
[স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো,
চাষাভুষার কাব্য (১৯৮১)]
একটি জাতির জীবনে যখন স্বাধিকার ও মুক্তির প্রসব বেদনা শুরু হয়, তখন সেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন নেতার। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়কাল থেকেই ধীরে ধীরে সেই নেতৃত্বের জায়গায় শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা) নিজের অবস্থানটি পোক্ত করছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচবারে ১০১৪ দিন কারাভোগ করেন। ২৩ বছর রাজনৈতিক জীবনের জন্য ১৪ বছর কারাভোগ করেছেন। জীবনের ৪০ শতাংশ সময় (আবুল বারকাত, বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ, পৃষ্ঠা ৭৩) জেলখানায় কাটালেও যে সময়টুকু বাইরে ছিলেন, তার সবটুকুই বলা চলে তিনি ব্যয় করেছেন বাঙালি জাতির স্বাধিকার এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য (দেখুন ৭ মার্চের ভাষণ)। ড. বারকাতের হিসাবে, বঙ্গবন্ধু সারা জীবনে মাত্র ১২ শতাংশ সময় (গড়ে দৈনিক ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা) ঘুমিয়েছেন।
সকল বাঙালিকে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়া উচিত। জানা উচিত তাঁর শৈশব ও কৈশোরের সকল কথা। সেই শৈশবে সাহসী নেতৃত্বের কারণে মাধ্যমিক স্কুলে অধ্যয়নকালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আনুকল্য ও তাঁদের সহচর্যে আসার সুযোগ পেয়ে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন তিনি। কলকাতায় অবস্থানকালে শেখ মুজিব গৃহাভ্যন্তরীণ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সহচর্য অর্জন করেন। আবার মহাত্ম গান্ধীর রাজনৈতিক আদর্শের বার্তা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, স্বরাজ আর রিম্যুভাল অব আনটাচেবিলিটি ও গ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। নেতাজী এবং গান্ধীর আদর্শ গ্রহণ করে তাঁদের যেসব ব্যর্থতা ছিল তা এড়িয়ে বাঙালির মুক্তির ছক আঁকেন।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো। এক হাজার মাইলের ব্যবধানে দুই পাকিস্তানে মাত্র ৭% লোকের ভাষা উর্দুকে ৫৪% বাংলা ভাষাভাষি জনগণের ওপর চাপানোর চেষ্টা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সংগ্রাম পরিষদের অনেক নেতা আপোস করার অভিপ্রায়ে দোদুল্যমানতায় ভুগছিলেন তখন শেখ মুজিব ১০ মার্চ ১৯৪৮ সালে ঘোষণা করেন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম চলবে প্রবলভাবে। ১১ মার্চ ১৯৪৮-এ গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিব। ১৫ মার্চ জেল থেকে মুক্তি পেলেও ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবার তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বন্দী মুক্তির দাবিতে কারাগারের অভ্যন্তরে আমরণ অনশন শুরু করলে উত্তেজনা কমাতে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। শেখ মুজিবকে ফরিদপুরে নেওয়ার সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করেন যেন একুশে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল মিছিল শেষে আইনসভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে স্বাক্ষর আদায় করা হয়।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলীম লীগের কনভেনশনে ২৯ বছর বয়সের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেই যুগ্ম সম্পাদক ৮ মার্চ ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কৃষি ও বনমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের ক্ষুরধার নেতৃত্বে অতি দ্রুত তীক্ষ্ণ হতে থাকে। তাঁর নেতৃত্বের কারণে ১৯৫৪ থেকে পরবর্তী বছরগুলো অর্থাৎ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বাঙালির জাতীয়তাবাদের উত্তরণ ঘটে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের প্রথম আন্দোলনের মাধ্যমে একমঞ্চে নিয়ে আসে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ৬ দফা। অর্থাৎ ষাটের দশকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে তাঁর উত্থাপিত ৬ দফাই বাঙালি জাতির জন্য ম্যাগনাকার্টা হিসেবে সামনে আসে। যার পরিণতি ১৯৬৯ সালে ১১-দফা ভিত্তিক গণঅভ্যূত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তানের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বাঙ্গালির কন্ঠ ছিল স্লোগানমুখর। উনসত্তরের আইয়ুববিরোধী গণঅভুত্থ্যানে বাঙ্গালি ছাত্র ও সাধারণ মানুষের স্লোগান মুখর কণ্ঠে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হতে থাকে তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা‘, পিন্ডি না ঢাকা/ঢাকা ঢাকা, তুমি কে আমি কে/বাঙ্গালী বাঙ্গালী এ ধরনের স্লোগান। কিন্তু বাঙ্গালির রক্তে আগুন ধরানো মুক্তির স্লোগান তখনো প্রকাশিত হয়নি।
বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উত্থানকে ঠেকাতে বাঙ্গালির মুক্তি সংগ্রামের সামনে থাকা সৈনিকদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ালেও তা বাঙ্গালিকে আরো জাগিয়ে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিণত করে জাতীয় বীরে।
“১৯৬৮ সালের কথা।।ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ প্রকাশিত বুলেটিন ‘প্রতিধ্বনি’র শেষ পৃষ্ঠায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের প্রথম ব্যবহার হয়। এর শিরোনাম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রস্তাবিত পূর্ব বাংলার ‘মুক্তি সনদ’ ছয় দফা। ‘বঙ্গবন্ধু’ দুই শব্দের আলাদা করে ছাপা হয়েছিল। শেখ মুজিবের জন্য এই উপাধির আবিষ্কর্তা ছিলেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতা এবং ওই সময়ে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক মুশতাক। বিষয়টি একসময় সিরাজুল আলম খানের কানে যায়। তিনি এটা ‘অনুমোদন’ করেন। ১৯৬৯ সারের ২৩ ফেব্রুয়ারি সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তী সময়ে যার নাম হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, সেই সভায় তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘ বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে ঘোষণা দেন।” (শেখ মুজিব যেমন করে ‘বঙ্গবন্ধু’ হলেন/মোস্তাফা জব্বার)
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা ও স্বাধীনতা শব্দ গুলো ওতোপ্রতভাবে ভাবে জড়িত। বাঙ্গালির ইতিহাস তো বটেই বাংলা ও বাঙ্গালির রাজনীতি ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম ম্লোগান বলা যায় এই জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ছাড়া জয় বাংলা যেমন অর্থহীন তেমনি জয় বাংল ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শব্দটি পূর্ণতা পায় না। অন্তত পক্ষে স্লোগানের ক্ষেত্রে। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান ধারন করেই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন সবাই। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু পংক্তিটি একটি কবিতার মতো আর এই কবিতার সৃষ্টি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকেই ঘিরেই। জয় বাংলা স্লোগানের স্ফূলিঙ্গ বঙ্গবন্ধু থেকেই টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই স্লোগানটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ১৯৭০ সালের ৭ই জুন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের শেষে জয় বাংলা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বস্তুত পক্ষে জয় বাংলা স্লোগানটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে শুধু মাত্র বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারণের পর থেকেই। ‘জয় বাংলা’ হয়ে উঠে প্রাণের ধ্বনি, হৃদয়ের ধ্বনি, মুক্তির ধ্বনি, যুদ্ধ জয়ের ধ্বনি, সুদীপ্ত সাহসের ধ্বনি। ‘জয় বাংলা’ হয়ে উঠে অগ্রগতির পাথেয়, জয়ের শক্তি। মূলত ‘জয় বাংলা’ হলো গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়ের স্লোগান, চেতনার স্লোগান, মাটির স্লোগান। ‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মার ধ্বনি। ‘জয় বাংলা’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান- বাঙালির স্লোগান, যুদ্ধে যাবার স্লোগান, যুদ্ধে বিজয়ের স্লোগান।
স্বাধীনতার ঈঙ্গিতবাহী এক সামরিক রণধ্বনির নাম জয় বাংলা। জয় বাংলা ধ্বনি সৃষ্টির আগে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষাও মূর্ত হতে পারেনি। অর্থাৎ জয়বাংলার ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমানবয়সী। জয় বাংলা স্লোগান সৃষ্টির মধ্যদিয়ে বাঙালি তার আত্মপরিচয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক নির্মাণ করে।
জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎপত্তি নজরুলের কবিতা থেকে নাকী ছাত্রলীগের মিছিল থেকে? জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, বঙ্গবন্ধু উপাধিসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অধিকাংশ সাংস্কৃতিক ধারণা ও মিথ প্রত্যক্ষ ময়দান থেকে এসেছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদের বিকল্প একটি ধ্বনির নাম জয় বাংলা। ৬৮-৬৯-এ দেশব্যাপী স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’র মতো ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির উদ্ভব।
বিভিন্ন মত থাকলেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎপত্তি প্রথম দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। সে সময় ফরিদপুর-মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণচন্দ্র দাস ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রবাদ পুরুষে পরিণত হন। একজন বাঙালি বীরের আত্মত্যাগ ও স্বজাত্যবোধে মুগ্ধ হয়ে পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তি উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন ১৯২২ সালে। কবিতাটি কবির ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। ওই কবিতায় কাজী নজরুল সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দ ব্যবহার করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাহসী বাঙালি নায়ককে সম্মান জানিয়ে কবি লেখেন– ‘ওগো অতীতের আজো–ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!/না–আসা–দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।/জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদী অন্তরীন!/জয় যুগে–যুগে –আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ–আদি –অন্তহীন/ স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর/ বাংলা–মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা ভাগীরথীর!’
জয় বাংলার উৎপত্তি সম্পর্কে আরও একটি তথ্য পাওয়া যায়। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত নবপর্যায় ‘নবযুগ’ পত্রিকার ৩ বৈশাখ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (১৯৪২) সংখ্যায় ‘বাঙালির বাঙলা’ নামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে নজরুল লেখেন, ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও; এই পবিত্র বাংলাদেশ, বাঙালির-আমাদের। দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয় তাড়াব আমরা করি না ভয় যত পরদেশী দস্যু ডাকাত রামাদের গামা’দেও বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙালির জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।’
বলা সঙ্গত হবে যে, ১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় ছিলেন এবং বিদ্রোহী কবির সেই উদ্দীপ্ত প্রবন্ধ তাকে নিশ্চিতভাবেই উজ্জীবিত করেছিল। আরও স্মরণযোগ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়।
তবে, খুব সম্ভবত ১৯৬৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভায় সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর থেকে প্রায় ব্যাপকভাবেই আন্দোলনরত ছাত্র নেতা-কর্মীরা তাদের বক্তৃতায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করতে থাকেন। এটি ব্যবহার হতে থাকে প্রতিটি জাতীয়তাবাদী সভা-সমাবেশে। রমনা রেসকোর্সে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ইতিহাস খ্যাত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হওয়ার ফলে তা ব্যাপকভাবে বাঙালি জনতার প্রাণের স্লোগানে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে ‘জয় বাংলা’ গোটা জনপদে জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনস্বীকার্য, জয় বাংলা ১৯৬৯ সালের পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে জাতীয় প্রেরণাশক্তি হয়ে উঠে, হয়ে উঠে জাগরণি স্লোগান। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচর রাজাকার, আল বদরদের প্রতিরোধে সমর স্লোগান হয়ে ওঠে জয় বাংলা।
➤(২০০৭ সালে আফতাব আহমাদ স্মরণে)
শামসুদ্দিন পেয়ারা সম্পাদিত ‘নক্ষত্রের দিন শেষ হয়’ গ্রন্থে প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ মুহূর্তের প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখায় ছাত্রলীগের প্রতিভাবান জ্যেষ্ঠ সংগঠক আফতাব আহমাদকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের প্রবর্তক বলা হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে। নিউক্লিয়াস’ দলের স্বাধীন বাংলার আকাঙ্ক্ষা থেকে এই স্লোগানের উৎপত্তি।
➤তৎকালীন ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী অংশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রনেতারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানের বিপরীতে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে এই রণধ্বনিটি তৈরি করে। রণধ্বনিটির উৎসের পেছনে পাকিস্তানের করাচির জনপ্রিয় ‘জিয়ে সিন্ধ’ স্লোগানের প্রভাব রয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘জয় হিন্দ’ ‘ভারত মাতা কি জয়’ ‘মহাত্মাজী কি জয়’ ‘নেতাজী কি জয়’ প্রভৃতি স্লোগানের প্রচলন থাকলেও জয় বাংলা স্লোগানের আগমন ঘটেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।
জয় বাংলা স্লোগান সৃষ্টির আরেক সাক্ষী মোস্তফা জব্বার রচিত ‘একাত্তর ও আমার যুদ্ধ’ মহিউদ্দিন আহমদের ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইয়ে জয় বাংলা স্লোগানের ইতিহাস ও উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘’১৯৬৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রথম দিন, অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে একটা সাধারণ ছাত্রসভা ডাকা হয়। সভা শুরু হলে জিন্নাহ হলের (পরবর্তী নাম সূর্য সেন হল) ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমাদ সবাইকে চমকে দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘জয় বাংলা’। ইকবাল হলের (পরবর্তী নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র চিশতি শাহ হেলালুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দেন ‘জয় বাংলা’ বলে। এভাবে তারা কয়েকবার স্লোগানটা দেন। ব্যাপারটা আকস্মিকভাবে ঘটে যায়।’’
আবু সাঈদ খানের ‘স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি’ গবেষণা গ্রন্থে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান বিষয়ে লিখেছেন, ‘৬৯ সালের গণআন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি গ্রুপটি এই ধ্বনি তোলে।’
সেদিন আফতাব আহমাদের মুখে উচ্চারিত স্লোগানটি ধীরে ধীরে সবার হয়ে ওঠে। একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাতে তারা ‘জয়বাংলা’ বলতে শুরু করেন। এভাবেই ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়।
মুজিবের স্বীকৃতি:
১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জয় বাংলা ধ্বনি থেকে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ দেশব্যাপী পতাকা উত্তোলন- জয়বাংলার এই ক্রমবিকাশ হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্র অভ্যুদ্যয়ের ইতিহাস। ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস গ্রুপের উদ্ভাবিত এই স্লোগানটির ব্যাপারে প্রথম দিকে আপত্তি ছিল খোদ আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের একাংশের। ছাত্র ইউনিয়নও স্লোগানটির বিরোধিতা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর স্লোগানটি ওই গ্রুপের কর্মীদের মুখে মুখে রাজপথে প্রচারিত হয়। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটি প্রথম জনসম্মুখে ধ্বনিত হয়। ওই সভামঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে দেবদারু পাতা দিয়ে ‘জয়বাংলা’ লেখা ছিল। কিন্তু ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারির আগে আওয়ামী লীগের মঞ্চ থেকে জয়বাংলা স্লোগান দেয়া সম্ভব হয়নি। ওইদিন আওয়ামী লীগের প্রবল বাধা অতিক্রম করে ছাত্রলীগ সভামঞ্চের চূড়ায় ‘জয়বাংলা’ লেখা বোর্ড ঝুলিয়েছিল। ১১ জানুয়ারি পল্টনের সমাবেশে শেখ মুজিব মঞ্চে এলে কে এম ওবায়দুর রহমান মাইক ছেড়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলে সিরাজুল আলম খান মাইকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। পরে এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চরম মতবিরোধ হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজুল আলম খানের ওই সম্ভাষণ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবের এই সম্মতিই ছিল জয় বাংলা স্লোগানের স্বীকৃতির গ্রিন সিগন্যাল। এই স্বীকৃতির মধ্যদিয়ে স্লোগানটির অবিসংবাদি হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। অনেকের মতে, ওই মঞ্চেই শেখ মুজিব প্রথম জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তবে অধিকাংশের মত, শেখ মুজিব প্রথম জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেন ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের জাতীয় জীবনের কয়েকটি জিয়নকাঠি আছে। এর একটি একুশে, একটি একাত্তর এবং একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এসবকে একত্রিত ও গ্রন্থিত করে, এসবের প্রতিপক্ষদের রুখে দাঁড়াবার শক্তি দান করে যা–তা ‘জয় বাংলা’।
৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তানের সৃষ্টি। তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মানুষগুলো দু’ভাগ হয়ে গেল; একটি অংশ পশ্চিমঙ্গে আর অপরটি পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের যাদুকরী মন্ত্রবলে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম। এ শ্লোগান পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মনোজগতও অধিকার করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা প্রসূত ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন দেখে তাঁরা। সময় এবং প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, উভয় ক্ষেত্রে কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে স্লোগানটি ।
স্বাধীনতার পর কলকাতা থেকে সাহিত্যিকদের একটি দল ঢাকায় এসেছিলেন। সেই দলের একজন ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, তিনি শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন “বাংলাদেশের আইডিয়াটা কবে প্রথম আপনার মাথায় এলো?” মুজিব মুচকি হেসে বলেছিলেন সেই ১৯৪৭ সালে।……তারপর তিনি বিমর্ষ হয়ে বললেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসু…তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা।”
বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশ্বের মানবতার প্রতীক। তা আজ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘Friends of the World’ বা বিশ্ববন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করে কূটনৈতিকরা। তাঁর ক্যারিসম্যাটিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ১৯৭৩ সালে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশ্ববন্ধু’ বলে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে বন্দী তখন কলকাতায় এক প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে কবি ও বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায় উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে উপস্থিতি না থাকতে পেরে রাতে বাড়িতে ফেরে লেখেন,
যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়
হবে হবে জয়
জয় শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক