নিজস্ব প্রতিবেদক, মোঃ সাইফুল আলম – আখাউড়া ডট কম
আখাউড়া যুদ্ধ অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী। বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো অনেক তথ্য জানা নেই কিন্তু রণাঙ্গনের মাঠ থেকে ফিরে এসে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন। তারা জানিয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি দায়িত্ব রয়েছে ও কিভাবে দেশ শাসন করতে হবে। দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিনের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারাই। শহীদ হয়েছেন অনেক বীর যোদ্ধা। আখাউড়াবাসী তথা সারাদেশ সবসময়ই তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন।
৩ নং সেক্টরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে মাত্র মাইল তিনেক দূরে অবস্থিত আখাউড়া। উত্তরে আশুগঞ্জ, দক্ষিণে কুমিল্লার সাথে এই জংশনের যোগসূত্র ছাড়াও এই স্থানটি অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পাকসেনারা তাই শক্ত ঘাঁটি করে দখলে রেখেছে এই জংশনকে কেন্দ্র করে। ঢাকা-সিলেট রেললাইন এই আখাউড়ার উপর দিয়ে চলে গেছে। পাক বাহিনী তাদের শক্তিশালী ২৭ পদাতিক ব্রিগেডের অংশ ১২ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স রেজিমেন্টকে দুটি ট্যাংক ট্রুপ সমেত এই এলাকার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত রেখেছিল। আশেপাশে পাকসেনা প্রচুর। আখাউড়া দখল করতে পারলে ঢাকার সাথে সিলেট এমনকি চট্টগ্রামের দিকেও অগ্রসর হওয়া সহজ হবে।
আখাউড়া যুদ্ধ ও এস ফোর্স:
এদিকে ‘এস ফোর্স’-এর অংশ ২ ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানিকে ‘ব্যাটল অফ বিলোনিয়া’র জন্য ফেনীতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিজেদের সেক্টরে ফেরত আসার পরই এই সেক্টরের সেনাদের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ দেখতে পান এস ফোর্সের কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ (কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ, বীর উত্তম)। বিলোনিয়ার যুদ্ধ সৈন্যদের আত্মবিশ্বাসের পারদকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, সেনাদের মনোবল হয়ে দাঁড়ায় পাহাড়সম। পাক বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে এত বড় অনুপ্রবেশ এবং এমনকি বিমান ভূপতিত করে এসেছে তারা। আর এ আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশের অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থান আখাউড়া দখলের ছক কাটেন কে এম সফিউল্লাহ। তারই পরিকল্পনায় আখাউড়া উদ্ধারে ১ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় ‘অপারেশন নাট ক্র্যাক’।
১. মূল আক্রমণ চালাচ্ছে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। নেতৃত্বে মেজর মঈন। এদের ওপর আখাউড়া থেকে সিঙ্গারবিল পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এদের ফায়ার সাপোর্ট দেবে মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট ‘মুজিব ব্যাটারি’ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী।
২. বিলোনিয়া থেকে যুদ্ধ করে আসা ডেল্টা কোম্পানি ২ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগ দিয়েছে। হেলাল মোর্শেদের এই কোম্পানি রাজাপুর এবং আলিমপুর গ্রামে অবস্থানকারী পাকসেনাদের ওপরে আক্রমণ চালাবে।
৩. ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নতুন ব্যাটালিয়ন সিলেট থেকে আখাউড়া আসার মহাসড়ক ধরে অবস্থান নিয়েছে। পাক বাহিনীর রিইনফোর্সমেন্টকে থামিয়ে দেবে এরা।
৪. ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা আগরতলার দিকের ধর্মঘরে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছে। এতে সিলেটের মনতলা হয়ে পাক বাহিনী পেছনের মুক্তিসেনাদের ওপর আক্রমণ করতে পারবে না। ধর্মঘরকে সামনে রেখে অবস্থান নিয়েছেন ডেল্টা কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া (মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া)।
৫. আরেকটি ব্যাটালিয়ন ৩০ তারিখে মুকুন্দপুর, হরশপুর এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ১১ রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর নাসিমের নেতৃত্বে থাকা ব্যাটালিয়নও ঘিরে রাখবে পাকবাহিনীকে। সেদিক দিয়ে শত্রু না আসা নিশ্চিত করবে তারা।
৬. ৩ নং সেক্টর থেকে দুই কোম্পানি নতুন সেনা (এদের ট্রুপস বলা হয়) আগরতলা বিমানবন্দরের উত্তর-পশ্চিম বরাবর বাংকার বানিয়ে অবস্থান নিয়েছে। এদের নেতৃত্বে আছেন মেজর মতিন (মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন বীর প্রতীক)। সবমিলে পরায় সবদিক থেকে পাকবাহিনীকে ঘিরে ধরার কৌশলে হাতছিল মুক্তিবাহিনী।
ইতিহাসবিদগণ সবাই জানেন, মূলত এস ফোর্স ছিল মেজর কে এম সফিউল্লাহের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এর সামরিক ব্রিগেড। এটি ১ অক্টোবর ১৯৭১ গঠন করা হয়, ব্রিগেডটি ২য় ও ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।
২৫ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্দয় ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)। তাদের পূর্ব পাকিস্তান এর রাজধানীতে উন্মাদের মতো হত্যাযজ্ঞ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যোগ দেন।
২৮ মার্চ কে এম সফিউল্লাহ এর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কর্মকর্তারা যাদের অবস্থান ছিল রাজধানী ঢাকা সংলগ্ন জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট, অন্যান্য সৈন্যদল এবং বাকি ক্যান্টনমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে। প্রাথমিকভাবে মেজর সফিউল্লাহ সেক্টর-৩ এর অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন।
৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পতাকা উড়ে আখাউড়ায়। নতুন ভোরের দেখা পায় আখাউড়াবাসী।