বৃষ্টির পানি দিয়ে বছরজুড়ে উৎপাদনে জিপিএইচ ইস্পাত

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীতাকুণ্ড উপজেলায় সারি সারি কারখানা। বন্দর থেকে কাঁচামাল আনা আর প্রস্তুত পণ্য মহাসড়ক দিয়ে সারা দেশে নেওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইস্পাত, ঢেউটিন কিংবা কাচের মতো কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। এত সব সুবিধা থাকার পরও পানির সংকটে দিশেহারা উদ্যোক্তারা।

পানির সংকটে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। মাটির নিচে হাজার ফুট গভীরে গিয়েও পানি না পাওয়ার নজির আছে এই উপজেলায়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিকল্প উৎসের সন্ধানে নেমেছেন উদ্যোক্তারা। তাদের মধ্যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের জিপিএইচ ইস্পাত।

প্রতিষ্ঠানটি পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা বৃষ্টির পানি বাঁধ দিয়ে সংরক্ষণ করে রড উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে। শুধু তা–ই নয়, এই পানি আশপাশের বাসিন্দারা দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহার করছে। পানিতে হাঁস চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে ২০টি পরিবার। আবার ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহৃত পানি অপচয় না করে তা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে। তাতে কারখানাটির পানির অপচয়ের মাত্রাও কম। আবার ভূগর্ভের পানি ব্যবহার না করায় চাপ পড়বে না পরিবেশের ওপর।

পানি নিয়ে এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৭ জুন পালন হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মরুকরণ ও খরা প্রতিরোধ’ দিবস। খরা ও মরুময়তা প্রতিরোধে জিপিএইচ ইস্পাতের এই উদ্যোগ শিল্পকারখানার পানির সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে।

ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করলে আশপাশের এলাকায় পানির সংকট বাড়বে—এই চিন্তা থেকে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহারের বিকল্প পরিকল্পনা নেন। এ জন্য পরিবেশের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি না, তা একটি সরকারি সংস্থা দিয়ে সমীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের সুপারিশ পাওয়ার পরই পাহাড়ের পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ভূগর্ভের পানি ব্যবহার না করায় আশপাশের বাসিন্দাদেরও পানির সংকট তীব্র হয়নি।

জিপিএইচ ইস্পাতের জ্যেষ্ঠ উপমহাব্যবস্থাপক এ বি এম সাহেদুল আলম আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজার টন রড উৎপাদন হচ্ছে কারখানাটিতে। এই পরিমাণ রড উৎপাদনে গড়ে পানির প্রয়োজন হয় প্রায় ৪০ লাখ লিটার। এই সম্পূর্ণ পানির জোগান দেওয়া হচ্ছে সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানি থেকে।

তিনি আরও বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সবার জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পানির সংকট প্রকট হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ব্যবহার করায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমছে।

জিপিএইচ বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ইস্পাত কারখানা করছে। ইএএফ কোয়ান্টাম অর্থাৎ ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস কোয়ান্টাম ইস্পাতশিল্পের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এর চেয়ে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কার হয়নি। এটির প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানিসাশ্রয়ী।

সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় বলে এতে সর্বোচ্চ মাত্রায় পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রায় দুই হাজার চার শ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত এই কারখানায় উৎপাদন শুরু হয় গত বছর থেকে। উৎপাদনের শুরু থেকেই পানি নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল উদ্যোক্তাদের।

শহর এলাকায় ওয়াসার পানি বা গভীর নলকূপ থেকে পানির সংস্থান হলেও সীতাকুণ্ডে তা নেই। আবার এই উপজেলায় বিশেষ করে ইস্পাতশিল্পে যে পরিমাণ পানির চাহিদা রয়েছে তা ভূগর্ভের পানি দিয়ে মেটাতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা পানি পাবেন না। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান ভূগর্ভের পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকে ভাউজার বা পানিবাহী গাড়িতে পানি এনে কারখানার উৎপাদন সচল রাখতে হচ্ছে। ভাউজারে পানি আনা যেমন ব্যয়বহুল তেমনি ভূগর্ভের পানি ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতি হয়।

কারখানার কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর জন্য বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মালিকপক্ষ চার বছর আগে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয়। এরপর দুই বছর আগে পানি সংরক্ষণের কাজ শুরু করে, যা এখন পুরোদমে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংরক্ষণ করে পানি পাইপের মাধ্যমে পানি শোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর শোধন করে তা কারখানা ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা হয়।

এই উদ্যোগ দেখতে সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায় অবস্থিত জিপিএইচ কারখানা ও পানি সংরক্ষণ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, চারপাশে ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড়গুলোর পাদদেশে বৃষ্টির পানি জমতে জমতে কৃত্রিম হ্রদের আকার নিয়েছে। প্রায় ৬০ একর জায়গায় এই পানি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। পাহাড়গুলোতে করা হচ্ছে বনায়ন। রোপণ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি। সংরক্ষণ করা পানিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে।

জিপিএইচ ইস্পাতের এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। পানির বিকল্প যে উৎসগুলো আছে বিশেষ করে নদী থেকে পানি ব্যবহার উপযোগী করা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এই অবস্থায় চট্টগ্রামের একটি কারখানা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ইতিবাচক। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে।

সারা দেশে ইস্পাত পণ্য যত উৎপাদন হয় তার অন্তত ৬০ শতাংশই আসছে সীতাকুণ্ডের কারখানা থেকে। দেশের শীর্ষস্থানীয় চারটি কোম্পানির কারখানাই এখানে। আবার ছোট ছোট কারখানাও রয়েছে এই উপজেলায়। সব কটি শিল্পকারখানা পানির সংকটে বিপাকে আছে। সংকট মেটাতে ভাইজারে করে দূরদূরান্ত থেকে পানি এনে উৎপাদন সচল রাখছে। তাতে পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা গেলে দুশ্চিন্তা দূর হবে। সেই উদাহরণও তৈরি করেছে জিপিএইচ ইস্পাত।

পানির সংকটের বিষয়টি সুরাহা করতে শিল্পকারখানার উদ্যোক্তা ও চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে শিল্প মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রাম চেম্বার জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে পানির সংকট সমাধানের প্রস্তাবও দিয়েছিল। সরকারি উদ্যোগ বা উদ্যোক্তাদের নীতিসহায়তা দেওয়া হলে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করেই উপজেলার কারখানার উৎপাদন সচল রাখা যাবে। পানির সংকট কাটলে নতুন নতুন কারখানাও গড়ে উঠবে এই এলাকায়। এ মুহূর্তে পাহাড়ের পাদদেশে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করার জন্য সরকারের নীতিসহায়তা চান উদ্যোক্তারা। খবর প্রথম আলো।

Related Posts

About The Author

Add Comment