নিজস্ব প্রতিবেদক, মোঃ সাইফুল আলম – আখাউড়া ডট কম
বাংলাদেশে অনেক শাহ্ সুফি এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। বারো আউলিয়ার দেশ বা ৩৬০ আউলিয়ার দেশ হিসেবে এই বঙ্গভূমি পরিচিত লাভ করেছে যুগ যুগ ধরেই। জানা যায়, ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে হযরত শাহজালাল (র) ইসলাম প্রচারের জন্য সিলেটে এসেছিলেন ১৩০৩ সালে। তাদের সারথি ছিলেন সৈয়দ আহমদ গেছুদারাজ কল্লা শহীদ (র)। অনেকেই বলে থাকেন তিনি হযরত শাহজালাল (র) খুব কাছের লোক ছিলেন। আবার অনেকেই ভাবেন তিনি হযরত শাহজালাল (র) ভাগ্নে ছিলেন।
কেল্লা শহীদ মাজার বা কেল্লা বাবার দরগাহ অথবা খড়মপুর মাজার শরীফ যেই নামে বলুন ইতিহাস ও উপকথা অনেক প্রচলিত আছে এই মাজারকে কেন্দ্র করে।
আজকে আমরা তিনটি বহুল প্রচলিত ইতিহাস ও উপকথা আপনাদের মাঝে উপস্থানপন করবো। যা থেকে আপনারা আপনাদের বিস্ময় ধরে রাখতে পারবেন এই মাজার কে নিয়ে।
১। কেল্লা বাবার দরগাহ নিয়ে সবচেয়ে বেশী কাহিনী বা ইতিহাস প্রচলিত আছে তা হল খড়মপুর গ্রামের জেলেরা তিতাস নদীতে মাছ ধরাকে নিয়ে। সে সময় খড়মপুর গ্রামের জেলেরা তিতাস নদীতে মাছ ধরত । একদিন চৈতন্য দাস ও তার সঙ্গীরা তিতাস নদীতে মাছ ধরার সময় হঠাৎ তাদের জালে একটি খণ্ডিত মস্তক আটকা পড়ে। বিষয়টি দেখে জেলেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। খণ্ডিত মস্তকটি উঠাতে গেলে আল্লাহর কুদরতে খণ্ডিত মস্তকটি বলে ওঠে, “একজন আস্তিকের সাথে আর একজন নাস্তিকের কখনো মিল হতে পারে না। তোমরা যে পর্যন্ত কলেমা পাঠ করে মুসলমান না হবে ততক্ষণ আমার মস্তক স্পর্শ করবে না ।” খণ্ডিত মস্তকের কাছ থেকে এই কথা শোনার পর চৈতন দাস ও তার সাথীরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। খণ্ডিত মস্তকের নির্দেশ অনুযায়ী ইসলামি মতে খণ্ডিত মস্তকটি দাফন করে এবং তারা মাজারটির খাদেমদারিতে নিযুক্ত হন।
জেলেদের নাম হয় শাহবলা, শাহলো, শাহজাদা, শাহগোরা ও শাহর ওশন । তাঁরাই এ দরগাহের আদিম বংশধর। এরপর বংশ পরম্পনায় তাদের বংশধরেরা খাদেম হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
প্রতি বছর ওরস এর সময় হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এই মাজারে। সারা দেশ থেকে মানুষ বিভিন্ন পথে খড়মপুরে আসে। বিশেষ করে নৌকা যোগে ভক্তদের আসার দৃশ্য চোখে পরার মতো। সেখানে ভক্তরা নানা বক্তার বক্তব্য শোনেন এবং নাচ-গান-জিকির করেন। নারী-পুরুষ সকলেরই সমাগম ঘটে এখানে। ভক্তরা নানা ধরনের জিনিস দান করে যান এখানে। কেউ ফল, কেউ পশু কিংবা কেউ টাকা প্রদান করেন। সে সম্পদগুলো কোষাগারে জমা হয়। মাজারের খাদেম এখন আর ছোট পরিবারে সীমাবদ্ধ নেই। প্রথম খাদেমের বংশধর এখন অনেক হয়ে গেছে। বংশের এক অংশের সাথে আরেক অংশের বিরোধ। মাজার পরিচালনা নিয়ে তাদের মাঝে প্রচুর বিবাদ সৃষ্টি হয়। মাজার পরিচালনাকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনাও ঘটে।
২। দ্বিতীয় যে প্রচলিত কাহিনী রয়েছে সেটি হল সিলেটকে কেন্দ্র করে। তখনকার সময়ে সিলেটের রাজা ছিলেন গৌর গোবিন্দ এবং তিনি ছিলেন অত্যাচারী। তার অত্যাচারের হাত থেকে নিরীহ জনগণকে বাঁচাতে যুদ্ধে লিপ্ত হন হযরত শাহজালাল (র:)। ঐ যুদ্ধে হযরত গেছু দারাজ (র:)-ও অংশগ্রহণ করেন। রাজা গৌর গোবিন্দের ছিল সাত তলা বিশিষ্ট দুর্ভেদ্য এক প্রাসাদ। গৌর গোবিন্দ সহ রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অবস্থান করছিল প্রাসাদের ভেতরে। ভেতরে যাবার ফটক আবার অবরুদ্ধ। এমতাবস্থায় প্রাসাদকে জয় করার জন্য তীর-ধনুক দিয়ে কিছুক্ষণ চেষ্টা করা হলো। কিন্তু দূর থেকে কোনোভাবেই প্রাসাদ ভেদ করা যাচ্ছিল না।
এমন পরিস্থিতিতে ভিন্ন পথে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন হযরত শাহজালাল (র:)। তখন আসরের সময় হয়ে এসেছে। তিনি বললেন, “আমাদের মাঝে এমন কেউ কি আছে যে সারা জীবনে একবারও আসরের নামাজ জামাত ছাড়া আদায় করেনি?” এমন কঠিন শর্তে বলতে গেলে কেউই উত্তীর্ণ হবে না। কিন্তু খুঁজে একজনকে পাওয়া গেল যে তার জীবনের সকল আসর নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেছে। তিনি হলেন হযরত গেছু দারাজ (র:)। তাকে বলা হলো সাত তলা প্রাসাদের কাছে গিয়ে আযান দিতে। তিনিও আযান দিতে গেলেন। যখন তিনি আযানের প্রথম অংশ ‘আল্লাহু আকবার’ বললেন তখন সপ্ততলা প্রাসাদের একটি তলা মাটির তলায় গুড়িয়ে গেল। এরপর যখন ‘আশহাদুআল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বললেন তখন আরেকটি তলা গুড়িয়ে গেল। এভাবে আযানের সাতটি অংশ বলার সাথে সাথে দুর্ভেদ্য প্রাসাদের সাতটি তলা মাটির নীচে ধ্বসে যায়।
প্রাসাদ ধ্বংস হবার সাথে সাথে হুড়োহুড়ি দিয়ে বের হতে থাকে শত্রুপক্ষের সৈন্য। এক সৈন্য এসে পেছন দিক থেকে তলোয়ার দিয়ে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে হযরত গেছু দারাজ (র:)-এর। পাশেই ছিল নদী। কর্তিত এই মাথা গিয়ে পড়ে নদীতে। অন্যদিকে মাথাবিহীন অবস্থাতেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে দেহটি! জয় হবার আগ পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধ।
এরপর সময় অতিবাহিত হয় এবং পানির স্রোতে এটি ধীরে ধীরে সিলেট থেকে সরে যেতে থাকে। একসময় এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে চলে আসে। এভাবেই অলৌকিকভাবে তার মাজার শরিফ গড়ে উঠে।
৩। তৃতীয় কাহিনীটি আরও বেশী ভিন্নরকম। লোকের মুখে এখানে জানা যায়, হযরত গেছু দারাজ (র:) এর সাথে যুদ্ধ হয় গৌর গোবিন্দের। এখানে বলা হয়, গৌর গোবিন্দের একটি রহস্যময় কূপ ছিল। এর নাম ছিল জীয়ন কূপ। এই কূপে কোনো মৃত লাশকে ফেলে দিলে তা জীবিত হয়ে যেতো। হযরত শাহজালাল (র:)-এর সাথে যখন যুদ্ধ বাধে তখন মুসলিম বাহিনীর হাতে প্রচুর সৈন্য মারা যেতে থাকে। কিন্তু সেসব মৃত সৈন্য নিয়ে ফেলে দেয়া হতো সেই কূপের মাঝে। ফলে তারা আবারো জীবিত হয়ে যুদ্ধ শুরু করতো। এমন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের পক্ষে তাদেরকে হারানো অসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল।
একপর্যায়ে হযরত শাহজালাল (র:) উপলব্ধি করতে পারলেন যতক্ষণ না ঐ কূপটি ধ্বংস করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব নয়। যুদ্ধে তার সাথে ছিল তিন শত ষাট জন আউলিয়া। সবাইকে ডেকে বলা হলো কে পারবে সাহসের সাথে এই কূপটিকে ধ্বংস করে দিতে? ৩৬০ জনের কেউ রাজি হলো না। কারণ ইসলামি নিয়ম অনুসারে এটি সামনাসামনি যুদ্ধের চেয়েও কঠিন। এই কূপটিকে পাহারা দেবার জন্য আছে ৪০ জন উলঙ্গ নারী। এরকম স্থানে কোনো আউলিয়া যেতে পারেন না।
অবস্থা দেখে হযরত শাহজালাল (র:) খুব চিন্তিত হয়ে গেলেন। হযরত গেছু দারাজ (র:) ছিলেন হযরত শাহজালাল (র:)-এর ভাগ্নে, তিনি তার চিন্তিত মুখ দেখে আর সইতে পারলেন না। রাজি হলেন এই কঠিন কাজ তিনি করবেন। তার কাছে ছিল একটি ধারালো তরবারি। যখন তিনি কূপের নিকট গেলেন তখন ইসলামের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সেই তরবারি দিয়ে এক কোপে নিজের মস্তক নিজেই কেটে ফেলে দেন। মস্তকবিহীন রক্তাক্ত দেহ নিয়ে তিনি যখন সেই কূপের কাছে গেলেন তখন এই অবস্থা দেখে উলঙ্গ নারীদের সকলে উদ্ভ্রান্তের মতো ভয়ে পালিয়ে যায়। এরপর তিনি ঐ কূপে এক টুকরো গরুর মাংস ফেলেন। এটি ফেলাতে কূপের যাদুটি নষ্ট হয়ে যায়। মৃতকে পুনরায় জীবিত করার ক্ষমতা আর থাকে না এতে। গরুর মাংস ফেললে কেন জীবিত করার ক্ষমতা নষ্ট হবে সে সম্বন্ধে কোনোকিছু জানা যায়নি।
মস্তক ছাড়া দেহটি এরপর হযরত শাহজালাল (র:)-এর পায়ের সামনে গিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। এমন ত্যাগ দেখে সেদিন তিনি বলেছিলেন “কেউ যদি আমার দরগাহ জিয়ারত করতে আসে, তাহলে সে যেন সবার আগে কেল্লা শাহ-এর মাজার জিয়ারত করে নেয়। তা না হলে ঐ ব্যক্তির জিয়ারতের অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
বর্তমানে অনেক খাদেম বিশেষ করে তরুণদের মাঝে মাজার কেন্দ্রিক অনেক কর্মকাণ্ডে বিব্রত হতে দেখা যায়। বিশেষ করে পূজা অর্চনা, মাদকের আড্ডা, ভাণ্ডারী গানের জলসা, টাকা পয়সা ও সম্পদ বলিদানের বিষয় গুলো অনেকেই মানতে নারাজ। অনেকেই মাজার কেন্দ্রিক ব্যবসায় মেতেছেন। তাই অনেকেই দেখেও না দেখার ভান করছেন। যাইহোক, আপনিও ঘুরে দেখে আসতে পারেন খড়মপুর মাজার শরিফ ও আশেপাশের এলাকা গুলো।
ভ্রমণ, যোগাযোগ ও খরচঃ আপনি ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে করে আসতে পারেন। বাসে আসলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নেমে সিএনজি দিয়ে আসতে পারেন সরাসরি খড়মপুর মাজার গেইট। অথবা ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেনে করে আখাউড়া এসে অটো বা সিএনজি দিয়ে খড়মপুর মাজার গেইট। যেভাবেই আসেন বিভিন্ন পরিবহন ভেদে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ হতে পারে। আপনি চাইলে আখাউড়া বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোন হোটেলে থেকে যেতে পারেন।