বাংলাদেশ কি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। এ আশাই আমরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর লালন করেছিলাম।

এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (4IR) যুগ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পুরোনো পদ্ধতি, জ্ঞান ও অনমনীয় মানসিকতা আজকের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারবে না। পুরোনো প্রজন্মের নীতিনির্ধারকেরা এক পরীক্ষার মুখে পড়েছেন। তা হলো নতুন প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এ প্রযুক্তি আজ ব্যবসা ও সেবার গতি-প্রকৃতিকে রূপান্তরিত করছে।

এই 4IR আসলে কী? এ বিপ্লব উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা, সেবাসহ সামগ্রিক মানবজীবনকে মৌলিকভাবে রূপান্তরিত করেছে। প্রচলিত প্রথাগুলো সে অনুযায়ী পুনর্গঠন হচ্ছে। এ প্রযুক্তিগত অগ্রগতির যুগে ডিজিটাল, ফিজিক্যাল ও জৈবিক ব্যবস্থা একত্র হচ্ছে। আগের শিল্পবিপ্লবগুলোতে বাষ্পশক্তি, বিদ্যুৎ ও ডিজিটাল কম্পিউটিংয়ের মতো বিশেষ কিছু উদ্ভাবন প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিভিন্ন উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোর সমন্বয়ে ফিজিক্যাল ও ডিজিটাল জগতের মধ্যে সীমানা মুছে দিয়েছে। এই চতুর্থ বিপ্লব নির্মিত হচ্ছে ডিজিটাল বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে। এটি আন্তসংযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয়তার নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। আমাদের জীবনযাত্রা, কাজ ও পারস্পরিক সম্পর্ক মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কে কেন্দ্রে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মেশিন লার্নিং (এমএল), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), উন্নত রোবোটিকস, থ্রিডি প্রিন্টিং এবং জীবপ্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এগুলো উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার অসাধারণ অগ্রগতি ঘটাচ্ছে। যোগাযোগ, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবার মতো ক্ষেত্রে এই উদ্ভাবনগুলো কার্যক্রমকে পুনর্গঠন করছে। নিরাপত্তা, গ্রাহকসেবা এবং পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটছে। জীবপ্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধন করেছে। নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে জেনেটিক রোগের চিকিৎসা, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়।

বাংলাদেশে অনেক খাত এখনো ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক ধারা অনুসরণ করে। এগুলো মূলত স্বল্পদক্ষ, শ্রমনির্ভর ও কম প্রযুক্তিনির্ভর। এই পুরোনো পদ্ধতি ও মডেলের ওপর নির্ভরতা কৃষি, গার্মেন্টস উৎপাদন, ওষুধশিল্প, চামড়া ও জুতা, জাহাজ নির্মাণ ও ক্ষুদ্র উৎপাদনশীল শিল্পের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। এগুলো সম্মিলিতভাবে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে। এ খাতের বেশির ভাগই এখনো প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। সেখানে সঠিক চাষাবাদ, স্বয়ংক্রিয় সেচ ও জীবপ্রযুক্তির মতো আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত। যেসব দেশ কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণ করেছে, তারা অনেক বেশি উৎপাদনশীলতা অর্জন করেছে। ফলে তারা কম জমিতেও পানি দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে অন্যতম। তবে শিল্পটি মূলত শ্রমনির্ভর। সেখানে স্বয়ংক্রিয়তার ব্যবহার সীমিত। যদিও কারখানাগুলো কিছু স্বয়ংক্রিয় আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোগ করতে শুরু করেছে। সেলাই ও ফিনিশিংয়ের মতো কাজগুলো এখনো প্রধানত হাতেই সম্পন্ন হয়। ফলে বড় আকারে বৃদ্ধি বা দ্রুত পরিবর্তনশীল বাজারের চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত থেকে যাচ্ছে। ভিয়েতনাম ও চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের উৎপাদন লাইনগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করেছে। তাদের দক্ষতা বাড়ছে এবং খরচ কমছে। এর মাধ্যমে তারা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে পারছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে পরিচালিত হয়। সেখানে উৎপাদনশীলতা ক্ষুদ্র। স্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্র সীমিত। এই ব্যবসাগুলো সাধারণত স্বয়ংক্রিয়তার পরিবর্তে ম্যানুয়াল শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। তাদের বড় হয়ে ওঠার পরিসর সীমিত। অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো আইওটি এবং রোবোটিকসের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে পা রেখেছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তি আজও গ্রহণে অনেক পিছিয়ে আছে।

বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত এখনো ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এখনো ডিজিটাল সমাধানগুলো গ্রহণ করে উঠতে পারেনি। ফলে তাদের সম্প্রসারণ ও বৃদ্ধি সীমিত রয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল পেমেন্ট, লজিস্টিকস এবং গ্রাহক বিশ্লেষণের সঠিক ব্যবহার না থাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং বাজারে প্রবেশের গতি ধীরই রয়ে আছে। এ খাতকে উন্নত করতে সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ঘাটতি তো আছেই।

বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে হলে প্রচলিত ধরন থেকে সরে এসে উদ্ভাবনকে গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, দক্ষতা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। আর তা করার জন্য একটি ডিজিটালি দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি করা, গবেষণা ও উন্নয়নকে উচ্চমানে নিয়ে যাওয়া এবং উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে উৎসাহিত করার জন্য নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই পরিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের গ্র্যাজুয়েটদের শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নয়, বরং আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান, সহানুভূতি ও স্থিতিস্থাপকতার মতো দক্ষতার জন্যও প্রস্তুত করতে হবে। এই দক্ষতাগুলো বর্তমান বক্তৃতাভিত্তিক শিক্ষণপদ্ধতির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। এর সমাধানে, শিক্ষকদের বিকল্প শিক্ষণপদ্ধতি যেমন ফ্লিপড ক্লাসরুম লার্নিং, সমস্যাভিত্তিক শিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষণ ব্যবহার করতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে ব্যবস্থাকে খণ্ডিতভাবে না বুঝে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হয়। কাজেই গ্র্যাজুয়েটদের এমন কর্মশক্তি হতে হবে, যাঁদের রয়েছে গভীর দক্ষতা, আবার যাঁরা অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করতে সক্ষম। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমগুলো এমন পদ্ধতি অনুসরণ করে, যা জটিল সিস্টেমগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হয়। তবে এ পদ্ধতি আজকের আন্তসংযুক্ত বিশ্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এখন চাই আরও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।

প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, আন্তসংযুক্ত বিশ্বে বাঁচতে হলে অবিলম্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব–চালিত অর্থনীতিকে গ্রহণ এবং উচ্চশিক্ষার রূপান্তর ঘটাতে হবে। একই সময়ে সরকার প্রায় সাড়ে ছয় কোটি স্বল্পদক্ষ শ্রমিককে উপেক্ষা করতে পারে না। এই জরুরি সমস্যার সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত, উদ্ভাবনী সমাধান অত্যন্ত জরুরি। জাতি সেই অপেক্ষায় উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে।

Email: shahidul7371@gmail.com

Related Posts

About The Author