আশুগঞ্জ উপজেলার নামকরণের ইতিকথা

নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম
প্রমত্ত মেঘনার জলধারায় প্লাবিত উর্বর পলিমাটি দিয়ে গড়ে উঠেছে আশুগঞ্জ উপজেলা। মহাভারত প্রণেতা বেদব্যাসের পদ্ম পুরাণ গ্রন্থে ও জনশ্রুতিতে যে কালিদহ সায়র (কালিদাস সাগর) এর উল্লেখ পাওয়া যায় সেই কালিদহ সায়রের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে স্থল ও জনপদে পরিণত হয় আশুগঞ্জ।

১৮৯৮ খ্রিঃ সলিল কন্যা মেঘনার তটস্থিত সুপ্রাচীন জনপদ আশুগঞ্জের গোড়াপত্তন হয়। মূলতঃ চরচারতলা, আড়াইসিধা, যাত্রাপুর, বড়তল্লা, সোনারামপুর, তালশহর, সোহাগপুর, বাহাদুরপুর গ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠা এ জনপদ সুপ্রাচীনকাল থেকেই শিল্প, কৃষি, শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে অনন্য সাধারন ভূমিকা রেখে আসছে। ১৯৮৪ সালের ২৮ নভেম্বর আশুগঞ্জ থানার কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১৮ জুলাই ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ শুরু হয়। ২০০০ সালের ২৫ জুলাই আশুগঞ্জ থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। একই বছর ২৩ অক্টোবর থেকে শুরু হয় উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম। মেঘনা নদীর বদ্বীপ আশুগঞ্জ দেশের একটি উল্লেখযোগ্য বন্দর ও শিল্প নগরী। বৃটিশ শাসনামলে ইংরেজদের পাট ক্রয় কেন্দ্র ও পাটের বড় বাজার হিসেবে আশুগঞ্জের পরিচিতি ছিল। সময়ের ব্যবধানে ইংরেজরা এখানে অসংখ্য পাটকল স্থাপন করে। আশুগঞ্জের পাট সে সময় ইংল্যান্ডের শিল্পনগরী ডান্ডিতে রপ্তানি হতো। দেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প ‘‘আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প’,’ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ভারতীয় ট্রানজিটের আন্তর্জাতিক নৌবন্দর এখানেই অবস্থিত। এই উপজেলায় বর্তমানে ৩০টি মৌজা, ৪১টি গ্রাম, ৮ টি ইউনিয়ন। আশুগঞ্জ উপজেলাটি জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা ২৪৪ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২) এর অধীন।

  • প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে মেঘনা নদীর উপর অবস্থিত (ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী) সেতুটি, যা ভৈরব রেলওয়ে সেতু নামে সমধিক পরিচিত, এটি ১৯৩৭ সালে উদ্বোধন করা হয়। আশুগঞ্জ তহশিল অফিস (১৯০৪ সাল) উল্লেখযোগ্য।
আশুগঞ্জ উপজেলার নামকরণের ইতিকথা
  • মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী:
    ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন, শাহজাহান, ল্যান্স নায়েক আঃ হাই, সুবেদার সিরাজুল ইসলাম এবং সিপাহী আব্দুর রহমান শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী সন্দেহভাজন লোকদের ধরে এনে সাইলো বধ্যভূমিতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করত। পাকবাহিনী ৯ ডিসেম্বর সকালে আশুগঞ্জ-ভৈরব রেলসেতুর আশুগঞ্জের দিকের একাংশ ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে। সেতু ধ্বংস করার পর পাকবাহিনী আশুগঞ্জ ছেড়ে চলে গেছে এমন ধারণা থেকেই যৌথবাহিনী আশুগঞ্জ দখল করতে অগ্রসর হয়। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রায় ৫০ গজের মধ্যে আসামাত্র পাকবাহিনী অগ্রসরমান ১৮ রাজপুত বাহিনীর উপর প্রচন্ড হামলা চালায়। হামলায় মিত্রবাহিনীর ৪ জন সেনাঅফিসারসহ প্রায় ৭০ জন শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী আশুগঞ্জ ত্যাগ করে।

আরও পড়ুনঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া (ভাটি অঞ্চলের) জেলার ভূ-প্রকৃতির উৎপত্তি রহস্য

  • মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন:
    গণকবর ১টি (লালপুর বাজার);
    বধ্যভূমি ২টি (আশুগঞ্জ সাইলো)।
  • আশুগঞ্জ নামকরণ:
    সবুজ শ্যামল পাখি ডাকা ছায়া সুনিবিড় মেঘনা পাড়ের আজকের বিখ্যাত আশুগঞ্জের প্রতিষ্ঠাকাল প্রায় একশত একুশ বছর পূর্বে।আশুগঞ্জ পতিষ্ঠার পূর্বে মেঘনার পূর্ব পাড়ের জনগণ ভৈরব বাজারে গিয়েই তাদের দৈনন্দিন কেনাবেচা করত। প্রতি বুধবার বসত ভৈরবের সপ্তাহিক হাট। ভৈরব বাজারের তদানীন্তন মালিক ভৈরব বাবু কর্তৃক আরোপিত করভারে মেঘনার পূর্ব পাড়ের ক্রেতা-বিক্রেতারা অতিষ্ট হয়ে মেঘনার পূর্ব পাড়ে সৈকতের বালিকণা তথা সোনারামপুর মাঠের উপর হাট বসিয়ে নেয়। প্রতি বুধবারে নদী সৈকতের চিকচিক বালিকণার উপর হাট বসেই চললো। তখন অত্র এলাকা সরাইল পরগনার জমিদারের অধীন ছিল। তৎকালীন সরাইল পরগনার জমিদার কাশিম বাজারের মহারাজা আশুতোষ নাথ রায় আশাব্যঞ্জক এ সংবাদ জানতে পেরে তিনি উদ্যোক্তাদের ডেকে পাঠান। উদ্যোক্তাগণ মহারাজার ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেদের দুর্গতি অবসানের জন্য মহারাজার নামের সাথে মিল রেখে ঐ হাটকে ‘‘আশুগঞ্জ’’ নামকরণ করেন।

তথ্যঋণ:
১. ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ইতিকথা ।। এস এম শাহনূর
২. ইতিহাস ও ঐতিহ্যে আশুগঞ্জ, মোহাম্মদ কামাল হোসেন, পলাশ শিমুল ১৯৯৪, আশুগঞ্জ পলাশ শিমুল কচি-কাচার মেলা।
৩. উপজেলার নাম আশুগঞ্জ, মোহাম্মদ কামাল হোসেন, বিকাশ ২০০৮, সমন্বিত সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, আশুগঞ্জ।
৪. সমতট, ইতিহাস বিভাগের ৮ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী স্মারক (২০১০-২০১৮), ফিরোজ মিয়া কলেজ, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

লেখক: এস এম শাহনূর
কবি, মুক্তিযুদ্ধ, লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস গবেষক

Related Posts

About The Author