আম্মা বলেন পড়রে সোনা আব্বা বলেন মন দে,পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাঁপার গন্ধে। আমার কেবল ইচ্ছে করে নদীর ধারে থাকতে,বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে পাখির মতো ডাকতে। ’ আমাদের বেখেয়ালি শৈশবে এ কবিতা দিয়ে আল মাহমুদ অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছিলেন। শুধু কি শৈশব, না তো! পাখির মতো ডাকতে চাওয়া আল মাহমুদ গ্রাম বাংলার সব লোকজ কোলাহল নিয়ে উড়ে এলেন শহরে।এস এম শাহনূরের উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় ‘শব্দকথন’র আয়োজনে ভারচুয়ালি বাংলা সাহিত্যের এক ঝাঁক খ্যাতিমান কবি লেখকের অংশগ্রহণে কবি আল মাহমুদের জন্মদিন উদযাপন করা হয়। ১৯৩৬ সালের আজকের দিনে (১১ জুলাই) মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদের জন্ম।কবির বাবা মীর আবদুর রব। মা রওশন আরা মীর। স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম। ব্যক্তিজীবনে পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের জনক তিনি। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তবে দীর্ঘ নাম মুছে গিয়ে শুধু আল মাহমুদ নামটি বাংলা কবিতার জগতে ধরা দেয় ১৯৫৪ সালের দিকে।তখন ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্য-সাময়িকীগুলোতে তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য আল মাহমুদের কবিতা। দেশ-বিদেশে তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং শিশু সাহিত্য নিয়ে আল মাহমুদের বইয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। নির্বাচিত কবিতা ও গল্প সমগ্রও পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে। মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’। প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে এবং ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’ ১৯৬৬ সালে। কবি তার সোনালি কাবিনে নদীর মতো কবিতার ঢেউয়ে প্রবাহিত রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সনেট ছন্দের মেলবন্ধনে। চিত্রকল্পে আত্মিকতার দারুণ খোরাক জুগিয়েছেন পাঠক মহলে। এই গ্রন্থই তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। আল মাহমুদের ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ। ‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি।বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপার কারণে ফেরারি হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন, যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথেও। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় রচনা করেছেন কালজয়ী দু’টি উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ ও ‘উপমহাদেশ’। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ আল মাহমুদের সাড়া জাগানো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। তৎকালীন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদ এক সময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতেও কাজ করেছেন। সেখানে পরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন।বর্ষন মুখর বজ্র রাতে বিধাতাক্রান্ত অঙ্গে
কবিতার সোনার চামচ মুখে আবির্ভূত হলেন এ বঙ্গে।
আধুনিককালের ঈশপ জন্ম নিলেন তিতাস নদীর পাড়,
প্রেরণার ঝুলি আব্দুস শুক্কুর আল মাহমুদ নাম তাঁর।
সহসা আঠার বসন্তের এক আত্ম প্রত্যয়ী যুবক
ঢাকার পথে দিলেন পাড়ি মুখে কবিতার স্তবক।
পরনে খদ্দরের পায়জামা, পিরহান গায়ে
দুর্লভ রাবারের স্যান্ডেল ছিল দু’ পায়ে।
বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস
কথার জাদুয় অবাক বিশ্ব বিমোহিত বাংলাদেশ!
পূর্ববঙ্গীয় সত্ত্বাকে মৌলিকত্বে রচিলেন নিজ ভাষায়
বাংলা কবিতার রাজধানী ফের ফিরালেন ঢাকায়।
পিতা মীর আবদুর রবের জীবন হলো ধন্য
মাতা রওশন আরা মীরের জীবন অনন্য
সোনালী কাবিনের কবিকে জন্ম দিবার জন্য।
দেশের আনন্দে তাঁর কবি হৃদয় নেচে উঠেছে সুখে
কখনো বেদনায় দুমড়ে মুষড়ে গেছে স্বদেশের দুখে।
কী প্রেম দ্রোহ, দেশ, সাম্য, একেশ্বরবাদী পাঠ
বাংলা কবিতার রাজ্যে তিনিই একক সম্রাট।
শক্তি সাহস যুগিয়েছেন কবিপত্নী সৈয়দা নাদিরা বেগম
হে মহীয়সী বঙ্গ ললনা তোমাকে অভিবাদন ও স্বাগতম।
কবি মনের সুপ্ত সাধ ঠিকই পূরণ করলেন নিরঞ্জন
শুক্রবার দিন শেষে ফাল্গুনের রাতে ঘটালেন মিলন।
(স্বর্গছায়া কাব্যগ্রন্থ/ প্রকাশকাল-২০২৪)
[ রচনাকাল: হাজী ভবন,খিলবাড়ির টেক, বড়ইতলা বাজার। ঢাকা।
১০ জুলাই, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।]মাটি ও মানুষের কবি এস এম শাহনূরের নিজ জেলার প্রতি রয়েছে গভীর টান ও ভালোবাসা। ‘তিতাসডাঙা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
জন্ম জেলা বাউনবাইরা
পরাণ আমার থাকে পইড়া
দেশ বিদেশে নাই তুলনা
এমন জেলা কোথায় পাই।।
এই জেলার প্রতি, জেলার মানুষের প্রতি কিছু ক্ষোভ, দুঃখ রয়েছে কবির। এই ক্ষোভ মূলতঃ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। “বদলে গেছে তিতাসের জল!” কবিতায় তিনি লিখেছেন,
প্রিয় শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফেলে দীর্ঘশ্বাস!
হাজার বছরের কতনা অজানা কথাবলা
মসজিদ মন্দির গ্রন্থাগার ঝলসানো লাশ,
বলেকীনা বাঁকা চোখে লেখা হবে ইতিহাস!
অথচ একদিন,পদ্মা মেঘনা যমুনার মত কতো নদী
চেয়ে দেখত অপলকে তিতাসের বয়ে চলা নিরবধি।
এখনো সময় আছে ওরে উদাসী
যদি কেউ তোলে পাল
যদি কেউ ধরে হাল
বাঁচবে তিতাস পাড়ের অধিবাসী।
(তিতাসডাঙা কাব্যগ্রন্থে প্রকাশকাল- ২০২২)
[ রচনাকাল: ৮ এপ্রিল, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ। সো লা ম।]
লেখক: মানবাধিকার কর্মী ও রেজিস্ট্রার ইউনিভার্সিটি অব স্কিল ইনরিচমেন্ট এন্ড টেকনোলজি।