জনপত্র ডেস্ক: পবিত্র রমজান শুরু হতে এখনো এক মাসের কিছু বেশি সময় বাকি। কিন্তু তার আগেই কোনো কোনো নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত প্রায় দুই মাস ধরে ভোজ্য তেল সয়াবিন ও পামঅয়েলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সম্প্রতি দুই দফায় বেড়েছে চালের দাম। এছাড়া কয়েক দিনের ব্যবধানে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকায় রয়েছে পেঁয়াজ, আদা, ডিম ও মুরগি। ফলে ভোক্তারা এখনই শঙ্কিত রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও। এরই মধ্যে তারা রমজানে চাহিদামতো নিত্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে কোনো পণ্যের যৌক্তিক মূল্য কী হওয়া উচিত তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন যাতে কোনোভাবেই বেশি দামে ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রি করতে না পারে।
সূত্র জানিয়েছে, রমজানে যাতে কোনোভাবেই নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ে এজন্য কয়েক দফায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এবার ব্যবসায়ীরা রমজানের আগেই পণ্যের দাম বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে।
গত চার দিনের ব্যবধানে মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা কেজিতে দুই টাকা করে বেড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে দুই টাকা বেড়ে মাঝারিমানের চাল পাইজাম/লতা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৮ টাকা। এর আগের সপ্তাহে কেজিতে তিন টাকা বেড়েছে নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম। বর্তমানে নাজিরশাইল/মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৭০ টাকায়।
চালের পাশাপাশি গত কয়েক দিনের ব্যবধানে দাম বেড়েছে আলু, পেঁয়াজ, আদা ও মুরগির। গত সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। প্রতি কেজি আলুতে দুই টাকা বেড়ে ১৬ থেকে ২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া দেশি পেঁয়াজের কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজে দুই টাকা বেড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
এখনো ভোজ্য তেলের বাজার স্থিতিশীল হয়নি। উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে রান্নার অতি প্রয়োজনীয় এ পণ্যটি। গতকাল খুচরাবাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা ও খোলা সয়াবিন ১১৫ থেকে ১২০ টাকা বিক্রি হয়। এছাড়া সুপার পামঅয়েল ১০৫ থেকে ১০৭ টাকা লিটার বিক্রি হয়।
গত এক বছরের ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনে ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিনে ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও সুপার পামঅয়েলে ৩৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার কথা জানালেও কবে নাগাদ কমতে পারে এ ব্যাপারে কোনো আশার কথা শোনাননি ব্যবসায়ীরা।
এদিকে এবার রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। সংস্থাটি এবার গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ পণ্য নিয়ে মাঠে নামবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, প্রতি বছর দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা ২১ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানেই চাহিদা প্রায় ৪ লাখ টন। একইভাবে সারাবছর চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টনের।
এছাড়া সারা বছর ৫ লাখ টন মসুর ডালের মধ্যে রমজানে চাহিদা ৮০ হাজার টন। আর বছর জুড়ে ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদার ৯০ শতাংশই লাগে রমজানে। সেই সঙ্গে সারা বছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ থেকে ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা থাকে প্রায় ৫ লাখ টন পেঁয়াজের।
অথচ এই চাহিদার বিপরীতে এবার রমজানে টিসিবি আড়াই কোটি লিটার ভোজ্য তেল, ১৭ হাজার টন ডাল, ৬০০ টন ছোলা, ১৩ হাজার টন চিনি, ১৭ হাজার টন পেঁয়াজ ও অন্যান্য আরো কিছু পণ্য বিক্রি করবে বলে জানা গেছে। এপ্রিলের শুরু থেকে সারা দেশে ৫০০ ডিলারের মধ্যে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে। এর মধ্যে রাজধানীতে শতাধিক ডিলার পণ্য বিক্রি করবে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় এত অল্প পরিমাণ পণ্য দিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখতে টিসিবি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে—এ প্রশ্ন ভোক্তাদের?
টিসিবির ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুয়েল আহমেদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে টিসিবি একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এজন্য প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, রমজানে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে চিনি ও ভোজ্য তেলের। কিন্তু টিসিবি যে পরিমাণ সয়াবিন ও চিনি বিক্রির জন্য ডিলারপ্রতি বরাদ্দ দেয় তা দিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা কঠিন।
যদি ডিলারপ্রতি ১ টন করে সয়াবিন তেল বরাদ্দ দেয় তাহলে বাজারে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিদিন দুটি গুদাম থেকে ডিলারদের পণ্য সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এটা যদি চারটি গুদাম থেকে করা হয় তাহলে সকাল ১০টার মধ্যে ডিলাররা পণ্য নিয়ে স্পটে চলে যেতে পারে। এতে ভোক্তারাও দুপুরের মধ্যেই পণ্য কিনতে পারবে। এছাড়া রমজানে রাজধানীতে ডিলারের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এতে অধিক স্পটে টিসিবি তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবে যা বাজার স্থিতিশীল রাখতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে জানান তিনি।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবার টিসিবি গতবারের চেয়ে বেশি পরিমাণে পণ্য স্বল্পমূল্যে বিক্রি করবে। আশা করছি, বাজারে আমরা ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারব।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনিশ গত রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে না। তিনি বলেন, রমজান উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনো পণ্যের ঘাটতি হবে না। এছাড়া টিসিবির মাধ্যমেও এবার রমজানে আগের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করা হবে।