কেউ আখ কাটতে ব্যস্ত, কেউ আখ থেকে পাতা ছাড়াতে। অন্যদিকে ঘানির মাধ্যমে আখ থেকে রস বের করা হচ্ছে। সেই রস চুল্লিতে ঢেলে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু তরল গুড়। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের একটি বাড়ির চিত্র। স্থানীয়ভাবে এই গুড় ‘লালি’ নামে পরিচিত। এর চাহিদাও বেশ।এ উপজেলায় প্রতিবছর শীত মৌসুমে ঘানি টেনে আখমাড়াই করে রস থেকে তরল গুড় তৈরি হয়। স্থানীয় প্রায় ১৫০ জন কৃষক-শ্রমিকসহ ৮০ থেকে ৯০ জন ব্যবসায়ী লালি তৈরির প্রক্রিয়া ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এবারের শীত মৌসুমে এক কোটি টাকার বেশি তরল গুড় বা লালি বিক্রি হবে বলে ধারণা তাঁদের।
সাধারণত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত (বাংলা মাস অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ) সময়ে তরল গুড় বা লালি তৈরি করা হয়। বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ও দুলালপুর এলাকায় এই কর্মযজ্ঞ বেশি হয়। উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শীত মৌসুমে উপজেলার ১৬ থেকে ২০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে। ১ মণ লালি তৈরি করতে ৪০০ কেজি আখ লাগে। ১ কেজি লালির মূল্য ১৫০ টাকা। এ বছর ৮০ থেকে ১০০ টন তরল গুড় বা লালি উৎপাদিত হবে। যার বাজারমূল্য ১ কোটি ২০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা। উপজেলায় আটটি ঘানি আছে।
বিষ্ণুপুর গ্রামের সহিদ আকবার বলেন, তাঁরা ৫ জন মিলে ১০ লাখ টাকা খরচ করে ৩০ কানি জমিতে (৩০ শতকে ১ কানি) আখ চাষ করছেন। আর পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে লালি তৈরির সরঞ্জাম ও মহিষ কিনেছেন। এই মৌসুমে প্রায় ২০ লাখ টাকার লালি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।
শীত মৌসুমে বিজয়নগর উপজেলায় ৮০০ থেকে ১ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। ১ মণ লালি তৈরি করতে ৪০০ কেজি আখ লাগে। ১ কেজি লালির মূল্য ১৫০ টাকা। এ বছর ৮০ –০০ টন তরল গুড় বা লালি উৎপাদিত হবে। যার বাজারমূল্য ১ কোটি ২০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা।
স্থানীয় লোকজন জানান, প্রাচীন পদ্ধতি ঘানির মাধ্যমে আখের রস থেকে কয়েক যুগ ধরে তৈরি হচ্ছে লালি। শীতকালে মুড়ি বা বাসাবাড়িতে বানানো পিঠাপুলি এই তরল গুড় বা লালির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পছন্দ করেন অনেকেই। তরল গুড় বা লালি কিনতে এবং নিজ চোখে এর উৎপাদনের প্রক্রিয়া দেখতে বিভিন্ন লোকজন বিজয়নগরে আসেন।
সম্প্রতি উপজেলার বিষ্ণুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, একটি জমিতে বসে এক তরুণ আখের রস সংগ্রহ করছিলেন। তখন দুই চোখ ঢাকা একটি মহিষকে ঘানির চারপাশে ঘুরতে দেখা যায়। সেখানে আখমাড়াই হচ্ছে। আখের রস সংগ্রহ করে কড়াইয়ে ঢেলে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় তরল গুড় বা লালি। এতে রং বা অন্য কোনো উপাদান মেশানো হয় না।
বিষ্ণুপুর গ্রামের মো. শাহনেওয়াজ ১০ থেকে ১২ বছর ধরে আখের রস থেকে লালি তৈরি করে বিক্রি করছেন। সঙ্গে উপজেলার ঝন্টু মিয়া ও সাইফুল ইসলামকে নিয়ে এ বছর সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘আমরা জমি থেকে আখ কেটে ভ্যান গাড়িতে নিয়ে আসি। মহিষের ঘানি দিয়ে আখমাড়াই করে রস সংগ্রহ করা হয়। তারপর আখের রস মাটির চুলার ওপর রাখা বড় কড়াইয়ে ঢেলে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা জ্বাল (উত্তপ্ত) করা হয়। এভাবেই লালি বা তরল গুড় তৈরি হয়।’ তিনি আরও বলেন, লালি মানুষের কাছে ১৫০ টাকা কেজির দরে বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন জায়গার লোক আসেন এবং নিয়ে যান। একটি বড় কড়াইয়ে ২০০ লিটার আখের রস থেকে ৩০ থেকে ৩২ কেজি লালি তৈরি হয়। এ বছর তিন লাখ টাকা লাভ করতে পারবেন বলে আশা তাঁর।
উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল ওদুদ বলেন, উপজেলার ১৫০ জন কৃষকসহ ৮০ থেকে ৯০ জন ব্যবসায়ী লালি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এ বছর ১৬ থেকে ২০ হেক্টর জমিতে ৮০০ থেকে ১ হাজার টন আখ উৎপাদিত হবে। ১ হেক্টর জমিতে ৫০ টন আখ উৎপাদিত হয়। এ বছর ৮০ থেকে ১০০ টন লালি তৈরি করা হবে।