আখাউড়া উপজেলার নামকরণের ইতিকথা

নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী স্থানে অবস্থিত আখাউড়া উপজেলা এক সময় পূর্ববঙ্গের প্রবেশদ্বার বলে পরিচিত ছিল। হাওড়া,তিতাস নদী এবং পিপুলি বিলের আখাউড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ উভয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক শহর। ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র থেকে প্রতীয়মান হয় তারও আগে কোন এক সময় এই অঞ্চলটি হরিকেল নামক জনপদের অংশ ছিল। কালক্রমে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের(১৮৫৭-১৯০৯) জমিদারির অংশে পরিণত হয়। [১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে (১৩০৭ ত্রিপুরাব্দে) মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য প্রায় ৪০ বৎসর বয়ঃক্রম কালে সিংহাসন আরোহণ করেন। ১] এই জমিদারের চাকলা রৌশনাবাদ এষ্টেটের মোগড়া রাজকাচারী ও আখাউড়াস্থ তহশীল কাচারী ছিল বর্তমান আখাউড়া সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে। এই কাচারী দুটির মাধ্যমে এই অঞ্চলের জমিদারীর যাবতীয় খাজনাদি আদায়সহ জমিদারী ব্যবস্থা ও কার্যাদি পরিচালিত হত। ব্রিটিশ আমলে আখাউড়া থেকে প্রচুর পাট সুদূর বিলেতের শিল্পনগরী ডাণ্ডিতে রপ্তানি হতো। ফলে ব্রিটিশ শাসনামলেও আখাউড়া রেলস্টেশনটি(১৮৯৭-৯৮ সালে আখাউড়া হয়ে বদরপুর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হয়) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে আখাউড়া বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন। এ জংশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহের রেলযোগাযোগ রয়েছে। তৎকালীন বৃটিশ আমল অর্থাৎ ইংরেজ শাসনামলে আখাউড়া (৫টি ইউনিয়ন) কসবা থানার অন্তর্গত ছিল। এই সময় একটি পুলিশ ফাঁড়ির মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হত। স্বাধীনতাত্তোরকালে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন তারিখে মনিয়ন্দ, ধরখার, মোগড়া, আখাউড়া উত্তর ও আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে আখাউড়া থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অত:পর ১৯৮৩ সনে তৎকালীন সরকারের প্রশাসন বিকেন্দ্রিকরণের অংশ হিসেবে ১৪.০৯.১৯৮৩খ্রিঃ তারিখে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। আখাউড়া পৌরসভা সৃষ্টি হয় ১৯৯৯ সালে।

আখাউড়া উপজেলাটি ৫টি ইউনিয়ন, ১০৭টি মৌজা ও ২২৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।

  • প্রাচীন নিদর্শনাদি, প্রত্নসম্পদ ও স্থাপনাগুলোর মধ্যে খড়মপুর হযরত সৈয়দ আহমদ গেছুদারাজ কল্লা শহীদ (রঃ) মাযার(১৮০০ শতাব্দী),ছতুরা দরবার শরীফ বড় মসজিদ, মোগড়ার মঠখোলা, মহারাজের কাচারী,আখাউড়া স্থলবন্দর(১৯৯৪ সালে চালু হয়। ১৯শে এপ্রিল ২০১১ থেকে এ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে আনুষ্ঠানিক ভাবে পন্য পরিবহন শুরু হয়), বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কবর উল্লেখযোগ্য।
  • খড়মপুর: যেন এক পৌরাণিক জনপদ।
    খড়মপুরে অবস্থিত তৎকালীন আগরতলা রাজ্যের মহারাজার দান করা ২৬০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হজরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ(র:)-এর দরগাহ যা কল্লা শহীদের দরগাহ নামে সমগ্র দেশে পরিচিত।
    মাজার কমপ্লেক্স সংলগ্ন প্রায় ১১শ বছরের পুরাতন মসজিদ। মসজিদের গায়ে লেখা আছে ৩শ ২৩ ত্রিপুরা। ত্রিপুরায় পুরনো বাংলা সন অনুসরণ করা হয়। কাজেই এই মসজিদের বয়স ১১ শ বছরের মতো।
  • গঙ্গাসাগর:
    কথিত আছে, প্রায় পনেরশ বছর আগে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা বীর বিক্রম ঈশ্বরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর তৎকালীন সময়ে এ অঞ্চলের পানীয় জলের অভাব দূর করতে বিশাল এই দীঘি খনন করে গঙ্গা দেবীর নামানুসারে দীঘির নাম দেন গঙ্গাসাগর। দীঘির উত্তরপাড়ের লাগোয়ো তফসিল কাচারী রাজার কর আদায়ের স্বাক্ষী। অন্ধকার ঘরটির ভেতরের মেঝেতে এখনও কয়েকটি সিন্দুকের শেষাংশের ছাপ ষ্পষ্ট। অতীতে নৌ-পথের গুরুত্ব যখন অধিক ছিল, তখন হাওড়া নদীর তীরবর্তী গঙ্গাসাগর ছিল মূলতঃ আগরতলার নদী-বন্দরস্বরূপ। গঙ্গাসাগরের পূর্বনাম ছিল রাজদরগঞ্জ বাজার। এ বাজার তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট ব্যাংক ‘দি এসোসিয়েটেড ব্যাংক লি. অফ ত্রিপুরা’র প্রধান অফিস হিসেবে স্থাপিত হয়েছিল। তখনো উপমহাদেশে ব্যাংকের প্রচলন সঠিকভাবে হয়নি। তাছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যের ভাটি অঞ্চলের খাজনা আদায়ের মহল অফিসও এ রাজদরগঞ্জ বাজারেই ছিল। রাজদরগঞ্জ বাজারের পরবর্তী নাম মোগড়া বাজার। এখানে ‘সেনাপতি বাড়ি’ নামে একটি জায়গা আছে। তাই মনে করা হয়ে থাকে যে, ত্রিপুরা-রাজ্যের কোন এক সেনাপতি এখানে বসবাস করতেন স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে।
  • ঘাগুটিয়া পদ্মবিল:
    পদ্ম ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo nucifera। গোত্রের নাম নিমফেসি। প্রাকৃতিক রুপ লাবণ্য ও অপার সৌন্দর্যে ভরা মনিয়ন্দ ইউনিয়নের বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী ঘাগুটিয়া(গ্রাম)পদ্মবিল। শরৎকাল এলেই ঘাগুটিয়ার এ বিলে ফুটে গোলাপি, হলুদ ও সাদা রঙের তিন প্রজাতির পদ্মফুল। তা দেখতে শিশু,কিশোর-কিশোরী,বৃদ্ধ সহ নানা বয়সের মানুষ এখানে প্রতিদিন সকাল বিকাল ভীড় জমায়। দখিনা বাতাসে পদ্ম ফুলের দোলানি দেখে মন ভরে যায় সবার। পদ্ম ফুলের ওপর ওড়াউড়ি করে নানান রঙের প্রজাপতি,হরেক প্রজাতির পাখী। পাখীদের কিচির মিচির শব্দ আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এসে আপনিও হারিয়ে যাবেন কোন এক অন্যলোকে।
  • মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী:
    ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আখাউড়া ২নং সেক্টরের অধীন ছিল। এ সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্রগুলো হচ্ছে আখাউড়া, দেবগ্রাম, তারাগণ, চেকপোস্ট সড়ক ও দরুইন। দরুইনে ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল মুখোমুখি লড়াইয়ে সিপাহী মোস্তফা কামাল শহীদ হন। এ গ্রামেই বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামালের সমাধি অবস্থিত।
  • মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন:
    মোগড়া গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ের (৩৩ জন শহীদ)গণকবর এবং আখাউড়া ত্রিপুরা সীমানাস্থ সেনারবাদী গণকবর।
  • আখাউড়া নামকরণ:
    ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থ রাজমালা থেকে জানা যায়, এলাকাটি এক সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সে সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা রাধাকৃষ্ণ মাণিক্য এই এলাকায় (রাধানগর গ্রামে) একটি রাধাকৃষ্ণের মন্দির স্থাপন করেন, যা স্থানীয় লোকজনের নিকট আখড়া নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে ভাষার বিকৃতি ঘটে আখড়া আখাউড়ায় রুপান্তর হয়।
  • নামকরণের পিছনের ইতিহাস:
    ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের জমিদারীর দ্বিতীয় রাজধানী ছিল কুমিল্লা। কুমিল্লার রাজবাড়ীতে যাতায়তের জন্য সে সময় আখাউড়া-আগরতলা সড়ক ব্যবহৃত হতো। এছাড়া আসাম বেঙ্গল রেলপথে চলাচলের জন্য জমিদার সপরিবারে আখাউড়া কাচারীতে অবস্থান করতেন।
    তিনি এ অঞ্চলের রাধানগরে রাধামাধবের আখড়া, দুর্গাপুরে দুর্গাদেবীর আখড়া, মোগড়া হাওড়া নদীর পাড়ের আখড়া, মনিয়ন্দের আখড়া ইত্যাদি নিজ খরচে নির্মাণ করেছিলেন। সে সময়ে এ অঞ্চলে আখড়ার আধিক্যের কারণে এটি কালক্রমে আখাউড়া নামে পরিচিতি লাভ করে।

তথ্যসূত্র:
১. রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৯
২. নামকরণের ইতিকথা।। এস এম শাহনূর
৩. রাজমালা।। কৈলাস চন্দ্র সিংহ
৪. আখাউড়া উপজেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।
৫. মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা।
৬. ↑ Fida, Quazi Abul (২০১২)। “Railway” ।
Islam, Sirajul; Jamal, Ahmed A.।
Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh (Second সংস্করণ)। Asiatic Society of Bangladesh।

লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।

Related Posts

About The Author

Add Comment