নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম
“হে রৌদ্র দীপ্ত প্রারম্ভে বর্ষ তোমাকে জানাই সু-স্বাগতম,
পুরনো দিনের গ্লানি মুছে পেয়েছি তোমাকে নব শীর্ষে।
তুমি আমাদের আশীষ হয়ে রবে কথা দাও নববর্ষে। “
(নববর্ষ /স্মৃতির মিছিলে কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত)
“ধর্ম যার যার উৎসব সবাবর।” এ উৎসবের নাম পহেলা বৈশাখ। যা বাঙ্গালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে গ্রামে ও আধুনিক নিয়ন আলোর শহরে লালন করে চলেছে। “এত ভঙ্গ বঙ্গ দেশ তবু রঙ্গ ভরা।” বৈশাখী মেলা, হালখাতা, পুণ্যাহ, পুরুষেরা বাংলার ঐতিহ্যবাহী পাজামা-পাঞ্জাবি আর ললনারা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে, সকালে পান্তা ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ, পিয়াজ সহ নানান রকম ভর্তা, আর ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এ ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য পান্তা ইলিশের স্বাদ নিতে অনেকে আগ্রহী হয়ে উঠেন এই উৎসবে। জানতে কি ইচ্ছা করে না কেমন করে শুরু হলো প্রাণের এ উৎসব?
বাংলা সংস্কৃতির জন্ম প্রাগৈতিহাসিক অনার্য কাল থেকে। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর মানুষেরাই প্রথমে এ সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করেছিল।তারপর এসে যুক্ত হয়েছে দ্রাবিড় ও অনার্য -ব্রহ্ম সংস্কৃতির ধারা। পরবর্তীতে তার সাথে মিলিত হয় সর্বভারতীয় পৌরাণিক সংস্কৃতির স্রোতধারা। আর সে সময় থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির সূত্রপাত। দ্বাদশ শতকের কাছাকাছি মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক মুসলিম সংস্কৃতি বিপ্লবের নতুন ধারা নিয়ে আসে। আঠারশতকে এলো ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার ঢেউ। বাঙালি তাকেও বেধেছে নিবিড় আলিঙ্গনে।
নববর্ষ শব্দটি নব+অব্দ =বর্ষ এর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। সকল দেশেই যতগুলো অব্দ বা বর্ষ অতিবাহিত হয় তার সবগুলোই নির্দিষ্ট কালিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত। বাংলায় আছে বার মাসে ছয়টি ঋতু। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা গেছে, ঋতু পরিক্রমায় যে মাসে যে নক্ষত্রের প্রাধান্য আকাশে পরিলক্ষিত হয়, সে নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়েছে। সে মোতাবেক পূষ্য নক্ষত্র থেকে পৌষ। মঘা= মাঘ। উত্তর ফাল্গুনী= ফাল্গুন। চিত্রা= চৈএ। বিশাখা =বৈশাখ। জোষ্ঠা =জৌষ্ঠ। পূর্বাষাঢা= আষাঢ। শ্রাবণী= শ্রাবণ। ভদ্রা= ভাদ্র। অশ্বিনী= আশ্বিন। কৃত্তিকা= কার্তিক মাসের নামকরণ করা হয়েছে।
(অগ্র+অয়ণ)= অগ্রহায়ণ নামের অর্থ অয়ণের প্রথম। প্রাচীন বাংলায় এ উওরায়নের শুরু থেকে বর্ষ শুরু হতো বলেই এ মাসের নাম অগ্রহায়ণ এবং একে বছরের প্রথম মাস হিসাবে ধরা হতো। সেকালে অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে বাঙালিরা নববর্ষের উৎসবে মেতে ওঠতো।
আপনি কি জানেন কেন এতো প্রাণ খুজে পাই এই উৎসবে? ‘পুণ্যাহ’ –বাংলা নববর্ষের একটা সর্বজনীন অনুষ্ঠান। ষাটের দশকে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়ে যাবার কারণে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা রয়ে গেছে। ‘পুণ্যাহ’ হলো পুণ্যের অহ বা পুণ্য কাজ অনুষ্ঠানের পহ্মে জ্যোতিষ শাস্ত্রানুমোদিত প্রশস্ত দিন।”‘ কিন্তু বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে, জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরে খাজনা আদায় করার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানের দিন ।
সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালে তাঁর আমাত্য ফতেহ উল্লাহ সিরাজী কৃষি নির্ভর বাংলায় রাজস্ব আদায়ের জন্য “ফসলের জন্য মাঠে বীজ বপনের প্রথম থেকে বছরের শুরু হবে এবং ফসল উঠা শেষ হলে বর্ষের সমাপ্তি ঘটবে।” এ নীতি অবলম্বন করেন। এ নীতি অনুসারে পহেলা বৈশাখ থেকে তিরিশে চৈএ পর্যন্ত বাংলা অব্দ বা বর্ষ চালু করা হয়।
বাংলার কৃষক সমাজ পহেলা বৈশাখের মধ্যে অনেকটা সময় হাতে পেয়ে ফতেহ উল্লাহ সিরাজী প্রবর্তিত নববর্ষের ঘোষণায় অত্যন্ত উল্লসিত হয় এবং পহেলা বৈশাখ সানন্দে গৃহীত হয়। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়।
“যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গ বাণী,
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
লেখক: এস. এম. শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক