নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম
লাইলাতুল কদর:
‘লাইলাতুল কদর’ দুটো আরবি শব্দ। শবেকদর হলো ‘লাইলাতুল কদর’-এর ফারসি পরিভাষা। ফারসি ‘শব’ অর্থ রাত আর আরবি ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থও রাত বা রজনি। আরবি ‘কদর’ অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত। সুতরাং লাইলাতুল কদরের অর্থ সম্মানিত রজনি বা মহিমান্বিত রজনি। মূলকথা আরবি লাইলাতুল কদর শব্দের ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা পারিভাষিক শব্দ হলো শবেকদর।
‘লাইলাতুল কদর’ পৃথক দুটো শব্দের সমষ্টি কিন্তু বাংলা অভিধানে শবেকদর একটি মাত্র শব্দ।
পবিত্র কুরআন, নির্ভরযোগ্য হাদিস ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর লাইলাতুল কদরের জন্য গৃহিত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সম্মানিত রজনির গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি এ কুরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম ও কল্যাণময়’ (সূরা আল কদর : ১-৩)। পবিত্র কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। এ জন্য কদরের আর একটি অর্থ হলো ভাগ্য। লাইলাতুল কদরের অর্থ হয় ভাগ্যরজনি।
- এই রাত কোন মাসে? এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রমজান এমন মাস যাতে কুরআন নাজিল হয়েছে’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)।
- এই রাত রমজানের কোন তারিখে? রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি রহস্যময় কারণে তারিখটি সুনির্দিষ্ট করেননি। হয়তো কদরের তালাশে বান্দাহ বিনিদ্র রজনি কাটাবে, সবর করবে এর মধ্যে খুঁজে পাবে সম্মানিত রাত, পাবে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত; ফেরেশতার অদৃশ্য মোলাকাতে সিক্ত হবে তার হৃদয়, আপন রবের ভালোবাসায় হবে সে উদ্বেলিত। এ যেন দীর্ঘ বিরহের পর আপনজনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
- হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, “নবি করিম (সা.) বলেছেন, ‘কদরের রাতকে রমজানের শেষ দশ রাতের কোন বেজোড় রাতে খোঁজ করো” (বুখারী ২০২০, ২০১৭, মুসলিম ১১৬৯,)।
- অবশ্য কোনো কোনো ইসলামী মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যামে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে) শবে কদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন।
এ রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয় (কুরাআন)। এ রাতে ইবাদতে মশগুল বান্দাহদের জন্য অবতরণকৃত ফেরেশতারা দোয়া করেন (হাদিস)।
“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর কাছ থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে”
(মুসলিম, হাদিস : ৭৬০; বুখারি, হাদিস : ২০১৪)। “এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না” (মিশকাত, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা-১৭৩; ইবনে মাজাহ : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২০)।
♦️ পবিত্র কোরান, হাদিসমতে কদর শব্দের আরো কিছু অর্থ-
১। কদর মানে তকদীর।
এই রজনিতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (কুরআন: ৪৪/৪)
২। কদরের আর একটি অর্থ হল, কদর, শান, মর্যাদা, মাহাত্ম্য, সম্মানিত ইত্যাদি।
আবু বকর আল আররাক বলেছেন, “এ রাতের নাম কদর রাত রাখা হয়েছে এ জন্য যে, যে লোক মূলত মান মর্যাদাসম্পন্ন নয় সে যদি এ রাতকে যথাযথভাবে গ্রহন করে ও জাগরণ করে আল্লাহর ইবাদত করে তাহলে সেও মর্যাদাবান ও সম্মানিত হবে।
৩। কদরের আর এক মানে হল সংকীর্ণতা; এ রাতে আসমান থেকে জমিনে এত বেশি সংখ্যক ফেরেশতা অবতরণ করেন যে, পৃথিবীতে তাদের জায়গা হয় না; বরং তাদের সমাবেশের জন্য পৃথিবী সংকীর্ণ হয়; তাই এ রাতকে শবেকদর বা সংকীর্ণতার রাত বলা হয়।
- বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে “লাইলাতুল কদর” এবং শবেকদর দুটো শব্দের ভুক্তি পাওয়া যায়।
অভিধানের ১২০১ পৃষ্ঠায় লাইলাতুল কদর |লাইলাতুল কদোর| শব্দের ভুক্তি রয়েছে। বলা আছে, পদে বিশেষ্য। অর্থ- ইসলাম ধর্মমতে রমজান মাসের শেষ দশদিনের যেকোনো বিজোড় তারিখের রাত; রমজান মাসের সাতাশ তারিখের রাত; পুণ্য রজনি। তবে শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে এখানে কোনো ঈঙ্গিত প্রদান করা হয়নি।
- বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের ১২২২ পৃষ্ঠায় শবেকদর |শবেকদোর্| শব্দের ভুক্তি রয়েছে। বলা আছে, পদে বিশেষ্য। অর্থ-ইসলাম ধর্মমতে যে রজনিতে হজরত মুহম্মদ (সা.) -এর নিকট পবিত্র কোরান (অবতীর্ণ) নাজিল হয়েছিল; মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ রজনি, লাইলাতুল-কদর, হিজরি পঞ্জিকার রমজান মাসের ২১ ২৩ ২৫ ২৭ বা ২৯ তারিখের রজনি। শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে বলা আছে ফারসি ‘শবে’ এবং আরবি ‘কদর’ শব্দের মিলনে [ফা. শবে+ আ. কদর] শবেকদর শব্দের উৎপত্তি।
সদকাতুল ফিতর:
সদকাতুল ফিতর (فطرة) মূলত দুটি আরবি শব্দের সমষ্টি। একটি হলো সদকা, অন্যটি ফিতর। ফিতরা আরবি শব্দ, যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর (ফিতরের জাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) ইত্যাদি নামে পরিচিত। সদকা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দান এবং ফিতর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উন্মুক্তকরণ বা রোজা ভঙ্গকরণ। “ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্যকেও বোঝানো হয় যা দ্বারা সওম পালনকারীরা তাদের সওম ভঙ্গ করেন।”(আল মুজাম আল ওয়াসিত, পৃষ্ঠা ৬৯৪)। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী রমজান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য বা এর সমমূল্য প্রদান করার নিয়মকে শরিয়তের পরিভাষায় সদকাতুল ফিতর বলা হয়। ইসলামী শরিয়ত মতে, সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।
সদকাতুল ফিতরের ইতিহাস:
অধিকাংশ ফিকহি গ্রন্থে জাকাত অধ্যায়ে এবং সিহাহ সিত্তাহর প্রায় সব ক’টি গ্রন্থে সদকাতুল ফিতর অবধারিত হওয়া প্রসঙ্গে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানুল মোবারকের রোজা ফরজ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) রোজা ফরজ হওয়ার বছরেই শাবান মাসে জাকাত ফরজ হওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেন। তবে জাকাতের মতো এ ক্ষেত্রে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরি নয়। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্নিত , ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা জব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটি ওয়াজিব। (বুখারি শরিফ, হাদিস ১৫১২) “যদি কোনো ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের চাঁদ উদয় হবার পর থেকে সেদিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা এর সমমূল্যের মালিক হয়, সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পত্তিটুকু তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়। তাহলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক। (তানভিরুল আবসার)।”
“রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর অবধারিত করেছেন অশ্লীল কথা ও অর্থহীন কাজ হতে মাহে রমজানের সওমকে পবিত্র করার জন্য এবং গরিব-মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। (সুনানে আবি দাউদ : ১৬০৯)।
আরও পড়ুনঃ তারাবি ও এতেকাফ শব্দের ব্যুৎপত্তি, অর্থ ও প্রমিত বাংলা বানান
সদকাতুল ফিতর হলো- জানের সদকা, মালের নয়। তবে জাকাত এবং সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের খাত অভিন্ন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, ‘জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত উসুলকারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন, তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।’ (সুরা তওবা : ৬০)।
♦️ বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘সদকাতুল ফিতর’ শব্দের ভুক্তি রাখা হয়নি। তবে এ যৌগিক শব্দটি যে দুটো আরবি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে অভিধানে পৃথকভাবে সে দুটো শব্দের ভুক্তি রয়েছে। ভিধানের ১২৭৯ পৃষ্ঠায় ‘সদকা’ শব্দের ভুক্তি রয়েছে। পদে বিশেষ্য। এখানে শব্দটির দুটো অর্থ সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
১। বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর নামে কোনোকিছু উৎসর্গ।
২। খয়রাত।
অভিধানে শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে বলা আছে, এটি একটি আরবি শব্দ।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের ৮৯৮ পৃষ্ঠায় ফিতরা শব্দের ভুক্তি রয়েছে। পদে বিশেষ্য। অর্থ- ইসলামধর্মের বিধান অনুযায়ী রমজান মাসব্যাপী উপবাসব্রত পালনের পর দরিদ্রকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল,গম বা তার সমপরিমাণ অর্থ দান করার রীতি।
এবং শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে বলা আছে, এটি একটি আরবি শব্দ।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।