কনকনে হিমেল বাতাস আর কুয়াশা মোড়ানো সকালটা শীত ঋতুর রূপ তুলে ধরা সুনির্মল বসুর কবিতার লাইনের মতো—‘ঝিমঝিমে হিম-হাওয়া বয় বারবার/ দিকে দিকে বাজে যেন শীতের সেতার।’
আজ সকাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে, বইছে হিমেল হাওয়া। তাপমাত্রার অবনমনে ঘরের বাইরে শরীরে কাঁপন ধরছে। এমন আবহাওয়ার মধ্যেই বিভিন্ন জেলার ৪০০ দৌড়বিদ জড়ো হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ মাঠে। সেখানে তরুণ-তরুণীরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠসহ শিশুরাও। তবে উচ্ছ্বাসে সবাই সমানে সমান। তাঁদের কেউ কলেজের শ্রেণিকক্ষে তাঁবু গেড়ে রাত্রিবাস করেছেন। কেউবা আশপাশের হোটেল বা স্বজনের বাড়িতে আগের রাতেই এসে উঠেছিলেন।
আজ শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাফ ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয়। এটি আয়োজন করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রানার্স কমিউনিটি (বিআরসি)।
আয়োজক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চার পর্যায়ের দূরত্বে এই হাফ ম্যারাথন দৌড় হয়। এর মধ্যে ছিল ২ কিলোমিটার, ৫ কিলোমিটার, ১০ কিলোমিটার ও ২১ কিলোমিটার। সকাল ৬টা ২০ মিনিটে থেকে ২১ কিলোমিটারে অংশগ্রহণকারী দলটি জেলার নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চবিদ্যালয় মাঠ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। পর্যায়ক্রমে রওনা দেয় ৫ ও ১০ কিলোমিটারের দলটি এবং সর্বশেষ শিশুদের ২ কিলোমিটারের দলটি সোয়া ৭টায় রওনা দেয়। ২১ কিলোমিটারে অংশ নিয়েছেন ১২০ জন। ১০ কিলোমিটারে ২০০ জন, ৫ কিলোমিটারে ৬০ জন ও ২ কিলোমিটারে ২০ শিশু। এর মধ্যে ৩৫০ জন পুরুষ, ৩০ জন নারী ও ২০ জন শিশু অংশ নেয়। পঞ্চাশোর্ধ্ব ছিল ৩৬ জন। মাঠ থেকে রওনা দিয়ে জেলার তিতাস নদীর ওপর নির্মিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগর উপজেলার সংযোগ সড়ক ব্রাহ্মণবাড়িয়া কালীবাড়ি মোড়-সীমনা সড়ক পথে ছড়িয়ে পড়েন দৌড় প্রতিযোগীরা। নির্দেশিত পথে যাঁর যাঁর দূরত্ব অনুযায়ী তাঁরা ছুটে যান।
দৌড় শেষে সীমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের শিমরাইলকান্দি সেতুর দক্ষিণ পাশের একটি জমিতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রানার্স কমিউনিটির উপদেষ্টা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক দিলারা আক্তার খান। অংশগ্রহণকারী সবার জন্য একটি করে শুভেচ্ছা স্মারক, সনদ, টি-শার্ট, সকালের নাশতার পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারকারীদের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ ট্রফি দেওয়া হয়। মোট ৯টি পর্যায়ে ২৭ জনের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি নগদ টাকা দেওয়া হয়। সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্সসহ ১০টি প্রতিষ্ঠান এই আয়োজনে সহায়তা করে। মেডিকেল সহায়তায় ছিল নোভেল জেনারেল হাসপাতাল। ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক এই আয়োজন সফলে কাজ করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ফারজানা তাসমিন মেয়ে পারিসা জুনাইরা চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে এই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে এসেছি। ভালো লাগছে। বর্তমানে শিশুরা মুঠোফোনে আসক্ত। মুঠোফোনের আসক্তি দূরে রাখতে এই দৌড় সহায়তা করবে। আমার মেয়ে অনেক খুশি হয়েছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার উত্তর লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা জুয়েফা আক্তার গাজীপুর শাহিন ক্যাডেট একাডেমির ভৈরব শাখার শিক্ষক। বাবা মো. আলাউদ্দিন ও বড়ভাই তৌহিদুল ইসলামকে নিয়ে এই দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন তিনি। তাঁরা সবাই ১০ কিলোমিটার দৌড়েছেন। জুয়েফা আক্তার বলেন, ‘হাফ ম্যারাথনে এই প্রথমবার অংশ নিয়ে ১০ কিলোমিটার দৌড়েছি। সঙ্গে বাবা ও ভাই ছিল। ভালো লেগেছে। সুস্থ থাকতে সবার দৌড়ানো উচিত।’
রানার্স কমিউনিটি সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের প্রভাষক রাজন মিয়া ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আখাউড়া শহীদ স্মৃতি কলেজের প্রভাষক অলি আহাদকে সঙ্গে নিয়ে ‘শরীর সুস্থ রাখতে’ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক দিলারা আক্তারের খানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তিনি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা।
অধ্যাপক দিলারা আক্তার খান বলেন, ‘সবাই মুঠোফোনে আসক্ত। অনেকে আবার মাদকে আসক্ত। শরীর সুস্থ রাখতে এবং মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমরা এই আয়োজন করে থাকি। বিভিন্ন জেলা থেকে সাড়া পেয়েছি। ফুল ম্যারাথন বলতে ৪২ কিলোমিটারকে বোঝায়। ভবিষ্যতে সেটি আয়োজন করতে চাই।’
বিআরসির প্রধান উদ্যোক্তা প্রভাষক রাজন মিয়া ও অলি আহাদ বলেন, ‘নিজেদের সুবিধামতো জায়গায় সংগঠনের সদস্যরা প্রতিদিন দৌড়ান। আমাদের একটাই লক্ষ্য। আমরা দৌড়াব, সুস্থ থাকব। আমরা স্মার্ট নাগরিক, রোগমুক্ত ও সচেতন জাতি গঠন করতে চাই। এই উদ্দেশ্যেই আমরা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি।’