বিজয়নগর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা

নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম

ইতিহাসে দক্ষিণ ভারতের একটি মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যের নাম বিজয়নগর।। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে (প্রথম) হরিহর ও তাঁর ভ্রাতা (প্রথম) বুক্কা রায় এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানী ছিলো বিজয়নগর। রাজধানীর নামে সাম্রাজ্যের নামও হয় বিজয়নগর সাম্রাজ্য। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে দক্ষিণ ভারত যখন ইসলামি রেনেসাঁ শুরু হয়, তখনও দাপটের সাথে টিকে ছিলো বিজয়নগর। কিন্তু ১৫৬৫ সালে দাক্ষিণাত্য সুলতানির নিকট যুদ্ধে পরাজিত হলে শুরু হয় এই সাম্রাজ্যের পতন।১৬৪৬ সাল পর্যন্ত বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো।[১]

তিতাস বিধৌত বিজয়নগর উপজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি নবসৃষ্ট উপজেলা এবং সুপ্রাচীন জনপদ। নিকারের [(National Implementation Committee for Administrative) প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার)] ১০৩ তম সভায় ৪৮২তম উপজেলা হিসাবে নবসৃষ্ট বিজয়নগর উপজেলার কার্যক্রম ৩ আগষ্ট ২০১০খ্রিঃ তারিখে শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রথম শুরু হয়। চাঁন্দুরা, হরষপুর, চম্পকনগর এবং বেদান্তি এর বৃহত্তম ইউনিয়ন। পূর্বে এটি ত্রিপুরা জেলার একটি অংশ ছিল। ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে (মোঘল সম্রাট) নূরুদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের শাসনকালে তার সেনাপতি প্রধান দাউদ খাঁ ত্রিপুরার রাজা থেকে এই অঞ্চল দখল করেছিলেন। অতপর দাউদ খাঁর নামানুসারে অত্র এলাকার নাম দাউদপুর পরগনা নামকরণ করা হয়েছিল।

দীর্ঘ সংগ্রামের পরে তিনি (দাউদ খান) প্রশাসনিক অধিপতি হিসাবে এখানে বসতি স্থাপন করেন। এই পরগনাটি পরবর্তীতে জালালপুর (ময়মনসিংহ) এর সাথে সংযুক্ত হয়। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশরা বাংলায় দেওয়ান (রাজস্ব সংগ্রহকারী) হিসাবে আগমন করেছিল। তারা প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে বহু জেলা তৈরি করেছিলেন। তারা ১৭৯০ সালে ত্রিপুরাকে পূনরায় জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। দাউদপুর পরগনাও ময়মনসিংহের একটি অংশ ছিল। ১৮৬০ সালে সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মহকুমা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। দাউদপুর, সরাইল, বেজুরা এবং হরিপুরকে ময়মনসিং থেকে পৃথক করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জমা দেওয়া হয়।[২] ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মহকুমা থেকে জেলা হিসাবে উন্নীত করে। লোহর, কালাছড়া, অলিয়াজুড়ি, মধ্যগঙ্গা, বালিয়াজুড়ি, পারেঙ্গা, দেউদিনা প্রভৃতি নদী সমূহ ছাড়াও হাওড়, সমতল ভূমি এবং ছোট পাহাড় এ তিন ধরনের ভূমিররূপ এর এক অপররূপ সমন্বয়ে গড়া উপজেলাটি ইতোপূর্বে ব্রা‏হ্ম‏ণবাড়িয়া সদর উপজেলার অন্তর্ভূক্ত হলেও তিতাস নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ভৌগলিকভাবে একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপজেলা বলে এখানে ভিন্নধর্মী একটি আবহ ও আমেজ রয়েছে। বৃটিশ শাসনামলে ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে এ উপজেলার সীমান্ত দিয়ে ব্র‏‏‏হ্ম‏ণবাড়িয়াসহ এত্দঅঞ্চলে স্থল যোগাযোগ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তার বাস্তব প্রমাণ প্রায় ১৭০ বছরের পুরাতন সিংগারবিলের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের যোগাযোগের প্রধান সড়কটি। যেটি এখনো ব্যবহার উপযোগী রয়েছে। লালমাটি সমৃদ্ধ বিষ্ণুপুর ও সিংগারবিল ইউনিয়নে রয়েছে প্রাকৃতিক কাঁঠাল, লিচু ও পেয়ারাসহ ভিন্ন ধর্মী নানা বৃক্ষর অপরূপ সমাহার। মননশীল মানুষকে এর সৌন্দর্য আকর্ষণ করবেই। তা ছাড়া কালাছড়া চা বাগানে নাম না জানা, বহু অজানা শহীদদের গণ কবর ও রয়েছে। সর্বমোট ২২১.১৭বর্গ কিমি (৮৫.৩৯ বর্গমাইল) আয়তনে ১০টি ইউনিয়ন, ১৬৮টি মৌজা, এবং ২৩০ টি গ্রাম নিয়ে বিজয়নগর উপজেলা গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ২৪৫নং নির্বাচনী এলাকা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ এর অংশ।

আরও পড়ুনঃ আখাউড়া উপজেলায় ৭ কিলোমিটার হেঁটে ও দৌড়ে ৭ বীরশ্রেষ্ঠকে স্মরণ

উপজেলার ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থানঃ

”দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক কর্ম-আদেশ পেয়ে বর্তমান বিজয়নগর উপজেলার অন্তর্গত সিঙ্গারবিল এলাকায় বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল ‘পি চক্রবর্তী এন্ড কোং’ নামের একটি কোম্পানি যার সদর অফিস ছিল (বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্মভিটা) সরাইল উপজেলার কালিগচ্ছ গ্রামে।” [৩]

তোফায়েল মোহাম্মদ (মেজর)স্মৃতিসৌধ:

১০ নং পাহাড়পুর ইউনিয়নের অর্ন্তগত ৯নং ওয়ার্ডে লক্ষীপুর গ্রাম, সেখানে ই পি আর বাহিনীর মেজর তোফায়েল মোহাম্মদ ও জমাদার আজম শত্রু কবলিত ১৯৭১ এর সেদিনের স্বদেশভূমি পুনর্দখলের যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন সেই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই স্মৃতিসৌধের নামেই তোফায়েল নগর বাজারের নাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের প্রধান সড়ক টি, এ রোডটির নামকরণ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা সড়ক:

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর তিতাস পূর্বাঞ্চলের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সাথে (তিতাস পূর্বাচল) বিজয়নগর উপজেলার সরাসরি বিকল্প শেখ হাসিনা সড়ক। ২০১০ সালের ১২ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কটি নির্মাণের ঘোষণা দেন।
গত ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের টানমনিপুর (পত্তন শিবির) এলাকায় সড়কের মাটি ভরাট কাজের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক কর্মী র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। স্থানীয় জনগণের দাবির মুখে স্থানীয় সংসদ সদস্য র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী সড়কটি প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনা সড়ক’ নামকরণ করে এর ফলক উদ্বোধন করেন। প্রায় ৪৩ কোটি ২৭ লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ডলি কনস্ট্রাকশন-ইনফ্রাটেক কর্তৃক যৌথভাবে কাজলা বিলের ওপর দিয়ে ২৪ ফুট প্রস্থে, (প্রায়) ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, রাস্তাটির কাজের সিংহভাগই সম্পন্ন হয়েছে। ১১৬ কোটি টাকা ব্যায়ে বালিয়াজুড়ী নদী, লইসক্যা খাল ও তিতাসের উপর সর্বমোট তিনটি ব্রীজ নির্মানের কাজও দৃশ্যমান। [৪]

নামকরণের পিছনের কথাঃ

লাল সবুজের বাংলাদেশে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল অগ্নিগর্ভ, বিস্ফোরন্মুখ যুদ্ধের নয় মাসের ইতিহাস অদম্য সাহস, অপরিসীম ত্যাগ ও সাফল্যের বীরত্বগাথাঁয় খঁচিত অম্লান ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়নগর উপজেলার রয়েছে বিরল এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ১৯ নভেম্বর এ উপজলার মুকুন্দপর সীমান্ত ফাঁড়ি আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়।সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯ নভেম্বর পাহাড়পুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর এলাকাটি সর্ব প্রথম মুক্ত হয়েছিল। যা মুকুন্দপুর দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালন করা হয়ে থাকে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ জন বন্দী হয়। হস্তগত হয় ২৭ টি রাইফেল, ২টি স্টেনগান, ২টি এলএমজি এবং ১X৩ ইঞ্চি মর্টার। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা এ ইউনিয়ন দিয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল।

বিজয়নগর উপজেলা নামকরণঃ

২০১০ সালের আগে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বিজয়নগর বলে কোনো শব্দ ছিল না। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯ নভেম্বর পাহাড়পুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর এলাকাটি সর্ব প্রথম মুক্ত হওয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা এ ইউনিয়ন দিয়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে প্রবেশ সহ বিস্ফোরন্মুখ যুদ্ধের নয় মাস এতদ অঞ্চলে মুহুর্মুহু যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ায় পুরো মুক্তিযুদ্ধে এ এলাকার গুরুত্ব বিবেচনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে নতুন একটি উপজেলা তৈরি করে এর নাম দেন বিজয়নগর উপজেলা।

পাদটীকাঃ

  • [১] ↑ Traditions in motion: religion and society in history By Supriya Varma, Satish Saberwal, Page no. 243
  • [২] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ)।। অচ্যুতচরণ চৌধুরী
  • [৩] অঞ্জলী লহ মোর মাতৃভূমি।। শিল্পপতি শান্তিব্রত চক্রবর্তী,কলকাতা।
  • [৪] বাংলাদেশের খবর।। প্রকাশিত ২৮ মে ২০১৯ ইং।
  • [৫] উপজেলা তথ্যবাতায়ন।

তথ্যসূত্র:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ইতিকথা।। এস এম শাহনূর

Related Posts

About The Author

Add Comment