মুক্তিযুদ্ধকালীন কসবা: হত্যা, গণহত্যা ও শহীদদের কবরের অবস্থান

নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম

১৯৮৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কসবা-আখাউড়া তথা গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে কয়েক হাজার তথ্য সংগ্রহ সহ তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করেন। ওনার সংগৃহীত বহু সাক্ষাৎকার ‘মুক্তিযুদ্ধে কসবা’ ও আরো অনেক গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ছাপা হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজ সংস্কৃতি ও ইতিহাস গ্রন্থের লেখক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন। আমার প্রিয় জন্ম উপজেলা কসবার মাটিতে ঘুমিয়ে থাকা জাতির সেরা আত্মোৎসর্গকারীদের শেষ ঠিকানার অবস্থান জানতে ওনার দ্বারস্থ হলে বেরিয়ে আসে চমৎকার কিছু তথ্য। আজকের এ লেখার অধিকাংশ তথ্যদাতা তিনি। যেগুলো আজ ইতিহাসে লেখা নেই,তবে আগামীতে এ তথ্যগুলো কসবা উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনায় অবদান রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

  • গোপীনাথপুর ইউনিয়ন:
    ২২ নভেম্বর পাক বাহিনীর গোলার আঘাতে নিহত (১) আঃ হালিম, [পরে বীর বিক্রম ; বাড়ি: চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলা।]
    ও (২) সেকেন্ড লেঃ আজিজুল হককে পাহাড় (চক) চন্দ্রপুর গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বের ৪৬৬ দাগে সমাহিত করা হয়। এখানে একটু উচু জায়গায় উপরোক্ত দুই শহীদের অরক্ষিত ও পরিত্যক্ত ২টি কবর রয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শহীদ আঃ হালিম,বীর বিক্রম এর স্বজনরা তাঁর কবরের খোঁজে কসবা আসেন।কিন্তু তখন কেউ তাঁর কবরের সন্ধান দিতে পারেনি। পরবর্তীতে উক্ত তথ্যদাতা তাঁর নিকটাত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করলেও কেউ আর আসেননি।

মুক্তিযুদ্ধের নথিপত্রে শহীদ সেকেন্ড লেঃ আজিজুল হকের কবর নোয়াখালীর লক্ষীপুর দেখানো হয়েছে।কিন্তু তথ্যদাতার মতে তাঁকে উপরোল্লিখিত স্থানেই সমাহিত করা হয়।

গোপীনাথপুর ইউনিয়ন অফিস চন্ডিদার বাজার টর্চার সেল। নিচু জমিতে মন্দিরের পাশে আনুমানিক ২৫০ জনকে পাকবাহিনী হত্যা করে মাটিতে পুতে ফেলে। [হতে পারে বধ্যভূমি]

গোপীনাথপুর ইউনিয়নের হরিয়াবহ গ্রামের মৃত ইউনূছ মিয়ার বাড়িতে ৩৫ জন লোকের একটি গণকবর আছে। [হতে পারে বধ্যভূমি]

২২ শে জুন হরিয়াবহ গ্রামের পাটের দালাল সোনা মিয়ার বাড়ির পশ্চিমে নিচু জমিতে শিশু ১২ জন,নারী ১৮ জন বৃদ্ধ নর নারী ১৬ ও কিশোরসহ ৭২ জনকে গুলি করে হত্যা করে। লাশগুলো ২/৩ দিন পড়ে ছিল।পরে পুকুরের উত্তর পাড়ে ও নিচু জমিতে পুতে রাখা হয়। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হরিয়াবহ গ্রামের জজু মিয়া আজও বেঁচে আছেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর।[ হতে পারে বধ্যভূমি]

পাটের দালান সোনা মিয়ার বাড়ির পুকুরের দক্ষিণ দিকে এক পথিককে পাক আর্মি জিজ্ঞাসা করে,
তুম নাম কিয়া হে?
পথিক বলেন- মুক্তল হোসেন
পাক আর্মি বলে- মুক্তি হে
না আমি মুক্তি না।আমি মুক্তল হোসেন।

তখন পাকবাহিনীর সদস্যরা তার ভাই আবুল হোসেন ও মুক্তল হোসেন দ্ধারা গর্ত খুড়ে দুইভাইকে জীবন্ত মাটিতে পুতে ফেলে।
তাদের বাড়ি ছিল একই ইউনিয়নের নোয়াগাঁও।

  • টর্চার সেল ইমামবাড়ি স্টেশন: একদিন গোপীনাথপুরের শতাধিক নারীকে ধরে নিয়ে যায়। এখানে বাছাই করে একই দিনে ১৭ জন নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
  • শহীদ শাহজাহান সরকার, পিতাঃ সুরুজ মিয়া সরকার, নেমতাবাদ, বিনাউটি। ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। মে মাসে ক্যাপ্টেন গাফফার তাকে রেকি করার জন্য প্রেরণ করেন। একটি ম্যাপসহ তিনি ধরা পড়লে পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে। কসবা ইমামবাড়ী রেলস্টেশনের উত্তর পাশে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। জি আর ম্যাপ সিট নম্বর ৩১১৩৩৪,৭৯ এম/১ [২]
  • বাদৈর ইউনিয়ন:
    ৮ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী কুটি থেকে চারগাছ যাওয়ার পথে মান্দারপুর গ্রামে ১১জন নিরীহ লোককে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখা যায়। মারা যাওয়া নিরীহ এ সকল শহীদদের মধ্যে বাদৈর গ্রামের ৭ জন এবং মান্দারপুরের ৪ জন ছিল। আনুমানিক ৪ জনকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাকীদেরকে মান্দারপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
    শহীদ মোঃ আবুল হোসেন, কসবা থানাধীন বাঁদৈর ইউনিয়নের, জমশেদপুর গ্রামের উত্তর পাশে তার কবর রয়েছে। [১]
  • বিনাউটি ইউনিয়ন:
    মে মাসের মাঝামাঝি সময়। ভারতে যাওয়ার পথে সৈয়দাবাদ সংলগ্ন এলাকায় মুরাদনগর উপজেলার গাঙেরকুটের ৩ জন হিন্দুকে হত্যা করে। সৈয়দাবাদ কলেজের পূর্বে ব্রীজের দক্ষিণে ( কলেজ গেইটের পশ্চিম দক্ষিণে) ঐ ৩ জন হিন্দুর লাশ সমাহিত করা হয়।

জ্যৈষ্ঠ মাসের ১ তারিখে হাজীপুর স্কুলের পশ্চিম দক্ষিণে ১৪ জন হিন্দুকে বেয়নেট চার্জ করে পরে গুলি করে হত্যা করে।
রাউৎহাটে ঋষী পাড়ার পশ্চিম দীঘির পশ্চিম উত্তর পাড়ে তাদের সমাহিত করা হয়। এদের সকলের বাড়ি রাউৎহাট ঋষী পাড়ায় ছিল।

এবং আষাঢ় মাসের শেষ দিকে সৈয়দাবাদ মোড়ের পশ্চিম পার্শ্বে ৮ জনকে ও আশ্বিনের মাঝামাঝি একই স্থানে ৭ জনকে একই সাড়িতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। [গণহত্যা]

বিনাউটির নওয়াপাড়ায় ভারতে যাওয়াপথে পাকবাহিনীর গুলিতে ৬ জন নিহত হয় এবং মৃত লাশগুলো ওখানেই পড়ে থাকে।

৬ ডিসেম্বরের পর কাকিনা ব্রীজের (কসবা আখাউড়ার সীমান্ত ব্রিজ) নীচে ২৫০/৩০০টি মানুষের মাথার খুলি পাওয়া যায়।

  • টি আলীর বাড়ি টর্চার সেল:
    আষাঢ় মাসের শেষের দিকে নৌকা থেকে চকচন্দ্রপুর থেকে ৫ জনকে ধরে নিয়ে টি আলীর বাড়ির টর্চার সেলে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এখানে বাড়ির চারপাশে নিচু জমিতে বহু মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে মাটিতে পুতে ফেলা হয়েছে বলে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ও টর্চার সেলে আটককৃতরা জানান। পুরো বাড়ির চারিপাশ হতে পারে একটি অনাবিষ্কৃত বধ্যভূমি।
  • কুটি ইউনিয়ন:
    কুটি-চৌমুহনী ফিশারীর উত্তর পশ্চিম দিকটা হতে পারে অনাবিষ্কৃত বধ্যভূমি। ফিশারীর পূর্বপাড়ের একটি বিল্ডিংয়ে আর্মি ক্যাম্প ছিল। এটি একটি টর্চার সেল ছিল।

১৪ এপ্রিলে কুটিতে ৪ জন নিরীহকে হত্যা করে।[গণহত্যা)
যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি প্রশাসন ১৫ এপ্রিল থেকে কসবা থানাকে কুটি গার্লস স্কুলের পাশে হিন্দু বিল্ডিংযে স্থানান্তর করে। এটাও একটি টর্চার সেল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুনঃ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিজয়ের ৫০বছর পূর্তি উদযাপন করছে বাঙালি জাতি

পুরকুইল গ্রামের এক আর্মি মুক্তিযোদ্ধা নর্থবেঙ্গল থেকে মাকে দেখতে আসেন। পথে কুটি-চৌমুহনীর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন স্থানে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। ওখানেই সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে কুটি-চৌমুহনীর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শহীদ মিনার রয়েছে।

মাইজখার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি টর্চার সেল ছিল। একইদিনে ৬৩জন নারীকে এখানে নিয়ে আসা হয়। রাজাকারদের সহযোগিতায় মুক্তিপণের মাধ্যমে এ টর্চার সেল থেকে নারীদের মুক্তি দেওয়া হত। এখানে অনেক নিরীহ বাঙালি ও মুক্তিদের হত্যা করা হয়।

  • কসবা পশ্চিম ইউনিয়ন:
    কসবা পশ্চিম ইউনিয়নের আকছিনায় ১ লা জ্যৈষ্ঠ তারিখে নূরুল ইসলাম মেম্বারের বাড়িতে এসে ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

বাউন গাওয়ের পথে ৪জন শরণার্থীকে ধরে এনে আড়াইবাড়ির ব্রীজে গুলি করে হত্যা করে। লাশ পানিতে ফেলে দেয়।
শাহপুরের রাক্ষসী পুকুরের দক্ষিণ দিকে কিছু লোককে জীবন্ত মাটি চাপা দেয়।
শাহপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশে পাশে বেশ কিছু লোককে হত্যা করে।

  • বায়েক ইউনিয়ন:
    বায়েকের শ্যামপুরে ৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একটি ম্মৃতিফলক রয়েছে।
    শহিদ আবুল কাশেম, (হাজিগঞ্জ) ও শহীদ সেলিম খান, বায়েক ইউনিয়নের শ্যামপুরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম ও সেলিম খান কে কবর দেওয়া হয়েছে। রঘুনাথপুরে নাম না জানা শহিদ মুক্তিযুদ্ধাদের কবর দেওয়া হয়েছে।[১]
  • মেহারী ইউনিয়ন:
    শহীদ আলমগীর কবির, বীর প্রতিক, আখাউড়া থানার নারায়ণপুর বাড়ি, ৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কসবায় পাকিবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহিদ হন। ঐ যুদ্ধে বেশকিছু পাকসেনা হতাহত হয়।শিমরাইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তাকে সমাহিত করা হয়। জি আর ম্যাপ সিট নম্বর ১৮১৩১৬, ৭৯ এম/১ [২]
  • কায়েমপুর ইউনিয়ন:
    কায়েমপুরের কামালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যাংকারে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করা হত।

তথ্যঋণ:
[১] মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া।। জয়দুল হোসেন
[২] সংগ্রামের নোটবুক.কম
[৩] মুক্তিযুদ্ধে কসবা।। ড. সুকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত
[৪] চারগাছ রণাঙ্গনের ৩ শহীদের সমাধি জমশেরপুর।। এস এম শাহনূর
[৫] কথোপকথন-
জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন
শিক্ষক, লেখক ও গবেষক।

লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।

Related Posts

About The Author

Add Comment