ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন ডাকসু নির্বাচনের আলোচনায় সরগরম। প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন, নিজেদের ইশতেহার জানান দিচ্ছেন। অন্যদিকে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের মধ্যেও বেশ রোমাঞ্চ টের পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচিত প্রার্থীদের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া কী হবে? কেমন নির্বাচন প্রত্যাশা করছেন তাঁরা?
এমন উৎসবের আমেজ ক্যাম্পাসে আগে দেখিনি
মুস্তাহিদ রিয়াদ, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে

ছয় বছর পর ফ্যাসিবাদমুক্ত ডাকসু হচ্ছে। এমন উৎসবের আমেজ আগে কখনো ক্যাম্পাসে দেখিনি। সবার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে, ডাকসুর মধ্য দিয়ে যেন নতুন এক রাজনীতির যাত্রা শুরু হচ্ছে। এখন একটাই প্রত্যাশা—একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, যেন শিক্ষার্থীরা যাঁকে যোগ্য প্রার্থী মনে করেন, তাঁকেই নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারেন।
লম্বা ট্রেনের মতো বিশাল বিশাল ইশতেহার দিচ্ছেন প্রার্থীরা। অথচ তাঁরা অনেকে হয়তো জানেনও না যে ডাকসুর কর্মপরিধি কতটুকু বিস্তৃত। ডাকসুকে শুধু মতাদর্শিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র বানালেই তো হবে না। প্রয়োজন সত্যিকারের শিক্ষার্থীবান্ধব সংস্কার। আমি মনে করি, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সবার আগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। প্রথমত, হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনীয় একাডেমিক সংস্কার। এর মধ্যে আছে সিলেবাসের গুণগত পরিবর্তন, বিভাগগুলোর শিক্ষার মান বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। নির্বাচিত প্রার্থীদের এমন অনেক বিষয়েই আওয়াজ তুলতে হবে।
সকাল-সন্ধ্যা মাইক বাজিয়ে সভা-সমাবেশ বন্ধ হোক
নাজিফা তাজনুর, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রথমবার ডাকসু নির্বাচন দেখছি, বেশ মজা লাগছে। চারদিকে ব্যানার-পোস্টার সাঁটা হয়ে গেছে, হলে-ক্যাম্পাসে প্রার্থীরা ভোট চাইছেন, ভোটারদের দাবিদাওয়া শুনছেন—সব মিলিয়ে সত্যিই উৎসব উৎসব ভাব চারদিকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আশার জায়গা যেমন অনেক, নিরাশার খাতাটাও বেশ ভারী। নতুন ডাকসুর কাছে তাই আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশাও সীমাহীন। একজন রোকেয়া হল নিবাসী হিসেবে আমার ব্যক্তিগত চাওয়া, রাজু ভাস্কর্য-টিএসসি-সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা বিকট শব্দে মাইক বাজিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন-আয়োজন বন্ধ হোক। বিশেষত সন্ধ্যার পর।
ঠিক এই মোড়েই রোকেয়া হল আর শামসুন্নাহার হল। হাজারখানেক শিক্ষার্থী এই হল দুটিতে থাকেন, যেখানে মোট ভোটারসংখ্যা ৯ হাজারের বেশি। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ আর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারও ঠিক পাশেই।
প্রায়ই এ এলাকায় জোরে মাইক বাজিয়ে সভা-সমিতি, অনুষ্ঠান হয়। তুমুল শব্দদূষণে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ক্লাস-পরীক্ষা ব্যাহত হয়, লাইব্রেরিতে পাঠরত শিক্ষার্থীদের পড়তে অসুবিধা হয়, হলের দৈনন্দিন কাজগুলোতেও ব্যাঘাত ঘটে। এমনও প্রায়ই হয়, পরদিন পরীক্ষা, কিন্তু রাজুতে-টিএসসিতে বা উদ্যানে দিনব্যাপী বিকট শব্দ আর চেঁচামেচিতে কেউই পড়তে পারছে না, অসহায় বসে আছে।
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে জ্ঞানের উৎপাদন ও বিতরণ। অন্যান্য পার্শ্বিক কারণে এ কাজ যেন ব্যাহত না হয়। ডাকসু প্রার্থীদের কাছে একটাই চাওয়া, তাঁরা নির্বাচিত হলে নিজেদের ইশতেহারে যা যা বলছেন, তা যেন পূরণ করেন। ৯ সেপ্টেম্বর একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। সব প্রার্থীর জন্য শুভকামনা।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নয়, ইশতেহার বাস্তবায়নে মনোযোগ চাই
মারিয়া রহমান, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

২০২৩ সালে ক্যাম্পাসে আসি। তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছাত্র থাকা অবস্থায় ডাকসু নির্বাচন দেখতে পারব কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম। সেই জায়গা থেকে অবশ্যই এবারের ডাকসু নির্বাচন আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে। নির্বাচনী পরিবেশ এখন পর্যন্ত তেমন অস্থিতিশীল নয়, কিছুটা রাজনৈতিক সহাবস্থানও আছে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে উত্থাপনের এই যে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে, এটাই শিক্ষার্থী হিসেবে আমাকে আনন্দিত করছে। নির্বাচিত প্রার্থীরা ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে মনোযোগী না হয়ে নিজেদের ইশতেহার বাস্তবায়নে মনোযোগ দেবেন, এটাই প্রত্যাশা। আগামী বছর যেন নির্বিঘ্নে ডাকসু নির্বাচন হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বও এবারের নির্বাচিতদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট আছে এবং সংকট থেকে রাতারাতি উত্তরণ সম্ভব নয়, এতটুকু আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। তবে কিছু মৌলিক বিষয়, যেমন আবাসনসংকট নিরসন, মানসম্মত ক্যানটিন স্থাপন, নারীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাসের নিশ্চয়তা, অনাবাসিক নারীদের হলে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সুবিধা উন্মুক্ত করা—ভোটার হিসেবে প্রতিনিধিদের কাছে এগুলোই আমার প্রথম প্রত্যাশা।
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি যেন প্রশ্রয় না পায়
প্রগতি চাকমা, প্রাচ্যকলা বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে বেশ উৎসবমুখর একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অনেক পরিচিত মুখ নতুন নেতৃত্বের জন্য উঠে এসেছেন, যা নির্বাচনে একধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। ফলে পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রায় সবার মধ্যেই একটা অন্য রকম আমেজ কাজ করছে।
সুস্থ–স্বাভাবিকভাবেই যেন নির্বাচনপ্রক্রিয়া শেষ হয়, এটাই এখন প্রত্যাশা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এ ব্যাপারে বেশ শক্ত অবস্থানে আছে বলেই মনে হচ্ছে।
ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী সর্বোচ্চ ছাত্র সংসদ, যার মূল কাজ হলো শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা। সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে অবশ্যই চাইব, আমাদের এই মৌলিক চাহিদাগুলো যেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পূরণ করেন। সেই সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করতে চাই। ক্যাম্পাসে যেসব লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বাধা তৈরি করে, সেসব যেন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রশ্রয় না দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশের শিক্ষার্থী প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসেন, যাঁদের প্রধান সংকট হচ্ছে হলে আবাসন। প্রথম বর্ষ থেকেই সুস্থ আবাসন নিশ্চিত করতে পারলে আশা করি ধীরে ধীরে শিক্ষাগত মানোন্নয়ন, সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ও নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা সম্ভব
নির্বাচিত হওয়ার পর যেন ইশতেহার ভুলে না যান
রাবিতা ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অবস্থা এমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ডাকসু নির্বাচন পাওয়ায় নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতেই হচ্ছে! এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ মোটামুটি ভালো। এ অবস্থা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।
একটা বিষয় চোখে পড়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্যানেলের সদস্য অথবা আগে থেকেই পরিচিত মুখ যাঁরা, তাঁরাই পাদপ্রদীপের আলো পাচ্ছেন। স্বাভাবিক। তবে নতুনদের জন্য সে ক্ষেত্রে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নতুনদের অনেককেই আমার কাছে যোগ্য মনে হয়েছে।
মানুষ কী দেখে কাউকে ভোট দেয়? নির্বাচনী ইশতেহার দেখে এবং সেটাই হওয়া উচিত, সেটাই যুক্তিযুক্ত। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীরা যেন নিজেদের ইশতেহার ভুলে না যান। ‘জিতেই তো গেছি, এখন আর ওসব মনে রেখে কী হবে’—এমন যেন না হয়। রাজনৈতিক দলের প্যানেল সদস্যরা যেন তাঁদের দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত না হন। কোনো দুর্নীতি বা প্রলোভনে পড়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির স্বভাব পাল্টে যাক, সেটাও চাই না। দলীয় প্যানেলের কেউ নির্বাচিত হলে ওই দলের শিক্ষার্থীদের প্রতি ‘স্বজনপ্রীতি’র মনোভাব সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রীদের অনুপাত প্রায় সমান হওয়ার পরও ছেলেদের ১৩টি আর মেয়েদের ৫টি হল! মেয়েদের হল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জমি দখল করা হয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করা দরকার। ক্যাম্পাসের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে মেয়েদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে