গ্যারেজে থেকে নষ্ট হচ্ছে ৬ কোটি টাকার ৪ অ্যাম্বুলেন্স

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) সুবিধা-সংবলিত চারটি অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট ও অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তিন বছর ধরে পড়ে থাকায় প্রায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের বিশেষায়িত যানগুলোর যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে অ্যাম্বুলেন্সগুলো চালু করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

এর বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর, জামালপুর, নাটোর ও চুয়াডাঙ্গা—এই আট জেলায় আইসিইউ সুবিধা-সংবলিত আরও ১৩টি বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স আছে। এর মধ্যে ৯টি বিভিন্ন হাসপাতালের গ্যারেজে অকেজো পড়ে আছে। রংপুর ও জামালপুরে দুটি অ্যাম্বুলেন্স মাঝেমধ্যে ব্যবহৃত হয়। আর সিলেট ও খুলনার অ্যাম্বুলেন্স দুটি ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। তখন আইসিইউ সুবিধা-সংবলিত ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স উপহার দেওয়ার ঘোষণা দেন। ওই বছরের শেষ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি করে এবং ২০২২ সালের মার্চে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও একটিসহ মোট চারটি বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। একেকটি অ্যাম্বুলেন্সের দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। অ্যাম্বুলেন্সগুলো সেই থেকে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গ্যারেজে পড়ে আছে।

তিনজন চিকিৎসক বলেছেন, বিশেষায়িত এই যানগুলো রোগী বহনের সময় চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স ও একজন সহযোগী থাকা বাধ্যতামূলক। যার বরাদ্দ তাঁদের নেই। গত তিন-চার বছরে কোনো রোগী পরিবহন করা হয়নি এগুলো দিয়ে। গ্যারেজে পড়ে থেকে যানগুলোর ইঞ্জিন ও ব্যাটারি নষ্ট হচ্ছে।

সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সের চালকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্সগুলো চালাতে অন্য অ্যাম্বুলেন্সের চেয়ে অনেক বেশি জ্বালানি লাগে। এ কারণে এগুলো পরিচালনায় খরচও বেশি। বেশি খরচ দিয়ে কেউ অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে চান না। তা ছাড়া যানগুলো চলেও ধীরগতিতে।

জেলা শহরের কান্দিপাড়ার বাসিন্দা ফারুক আহমেদ বলেন, মাস তিনেক আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক আত্মীয়ের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। ওই মুহূর্তে তাঁর জন্য আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন পড়েছিল। যোগাযোগ করলে জানানো হয়, বিশেষায়িত ওই অ্যাম্বুলেন্স ধীরগতিতে চলে এবং এর জন্য চিকিৎসক ও নার্স দরকার, যা তাঁদের নেই। পরে বিকল্প উপায়ে রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যান তাঁরা। তিনি আরও বলেন, নামেই শুধু আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স। এগুলো জেলাবাসীর কোনো কাজে আসছে না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারির সময় বিভিন্ন স্থানে টিকা পরিবহন কাজে বিশেষায়িত ওই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হয়। একদিন রোগী নিয়ে চালক ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু রাস্তায় দেখা দেয় বিপত্তি। কারণ, অ্যাম্বুলেন্সটি চলছিল ধীরগতিতে। তা দেখে রোগীর স্বজনেরা খেপে যান। মাঝপথে রোগীকে নামিয়ে অন্য অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ঢাকায় যান তাঁরা।

গত মঙ্গলবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের গ্যারেজে অ্যাম্বুলেন্সের ছবি তুলতে গেলে চালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গাড়িটি আর চালু করা যাচ্ছে না। 

বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রঞ্জন বর্মণ  বলেন, অ্যাম্বুলেন্স পাওয়ার ছয়-সাত মাস পর এক রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কিছুদিন পর উপজেলা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রোগী পাঠানো হয়। বর্তমানে অ্যাম্বুলেন্সটি গ্যারেজে পড়ে আছে। 

বিশেষায়িত এই অ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স ও সহযোগী থাকা বাধ্যতামূলক উল্লেখ করে আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিমেল খান বলেন, এটি নামেই আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স। দু-তিনবার রোগী পাঠিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন তাঁরা। ইঞ্জিন গরম হয়ে মাঝরাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ হয়ে গেছে। পরে অন্য অ্যাম্বুলেন্সে রোগীদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

নানা সমস্যার কারণে তিন বছর ধরে উপহার পাওয়া অ্যাম্বুলেন্স গ্যারেজে পড়ে আছে উল্লেখ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রতন কুমার বলেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

আংশিক সচল দুটি

২০২১ সালের ডিসেম্বরে জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে একটি ও মেলান্দহ উপজেলার গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরে আইসিইউ সুবিধা-সংবলিত আরও একটি বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সটি সেই থেকে হাসপাতাল চত্বরে একটি ছাউনির নিচে পড়ে আছে। এতে অ্যাম্বুলেন্সটির যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর মেলান্দহ উপজেলার গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের অ্যাম্বুলেন্সটি দরিদ্র রোগীরা মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্সটি মাঝেমধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে, হাসপাতালের পরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে বের করা হয়। রোগীদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্সের সরকারি ব্যয় বাবদ ৭ হাজার টাকা, তেল বাবদ ১০ হাজার টাকা ও অন্যান্য টোল রোগীর স্বজনদের দিতে হয়। এ ছাড়া চিকিৎসক ও নার্স রোগীর স্বজনদেরই দিতে হয় বলে জানালেন অ্যাম্বুলেন্সটির চালক হাসান আলী।

Related Posts

About The Author