নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম
তারাবি:
পবিত্র কুরআন এবং হাদিস শরিফে কোথাও তারাবি শব্দের উল্লেখ নেই। এ শব্দের প্রচলন হয়েছে বহু পরে। আরবে রমজানের এই নামাজকে “সালাতুল লাইল” বা রাতের নামাজ বলা হয়। রমজান মাসে তারাবি নামে যে নামাজ আদায় করা হয় তা কুরআন শরিফের সূরা মুজাম্মিলের ২০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে। হুকুম করা হয়েছে- “রাতে দীর্ঘ সময় ধরে দলবদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত করবে।” “ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে কোরআন আবৃত্তি করো।” [সূরা মুজাম্মিল, আয়াত-৪] হারাম শরিফে রমজান মাসে রাতের নামাজের সময় সারা রাত কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। রুহানিয়্যাতের আলোকমালায় পরিপূর্ণ রমজান মাসে দিনে রোজা আর রাতের বিশেষ নামাজ কিয়ামুল লাইল। তারাবি হচ্ছে এক ধরনের কিয়ামুল লাইল। কিয়ামুল লাইল হচ্ছে এশার নামাজের পর এবং ফজরের নামাজের আগ পর্যন্ত যেকোনো ইবাদত। আর রমজান মাসে এটা খুবই উৎকৃষ্ট ইবাদত।
তারাবি শব্দের অর্থ ও নামকরণ:
তারাবি [আরবি: تَرَاوِيْحِ] শব্দটি বহুবচন, এর একবচন হলো [তারবীহাতুন- تَروِيْحَة]তারাবিবাহ; যার আভিধানিক অর্থ হলো বসা, বিশ্রাম ও প্রশান্তি। ‘রমজান মাসে এশার নামাজের পর যে সুন্নত নামাজ কায়েম করা হয়, তা হলো তারাবির নামাজ।’ (কামুসুল ফিকাহ)। যেহেতু প্রতি চার রাকাত পরপর বিরতির মাধ্যমে বিশ্রাম নেওয়া হয়, তাই এ নামাজের এ নামকরণ করা হয়েছে।
অন্য কথায় হাদিস অনুযায়ী এ ইবাদত/ নামাজের মাধ্যমে রোজাদার চির শান্তির জান্নাতের অধিকারী হয়ে সেখানে বিশ্রাম ও প্রশান্তি লাভ করবে তাই এর নাম তারাবি।
প্রকৃতপক্ষে তারাবি হলো প্রশান্তির নামাজ। ‘কিয়ামুল লাইল’ বা রাতের নামাজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে (সুরা আস সাজদা: আয়াত নম্বর ১৬, সুরা বনী ইসরাঈল: আয়াত ৭৯, সুরা মুযযাম্মিল: আয়াত ১-৪, সুরা আয যারিয়াত: আয়াত ১৭ এবং সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৬-১৭) ও মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র হাদিসে তারাবি নামাজের ফজিলত ও বিধান সম্পর্কিত বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। নারী পুরুষ উভয়ের জন্য ২০ রাকাত নামাজ পড়া সুন্নতে মুআক্কাদাহ।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে রাত জেগে তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩০, হাদিস: ৩৬; ই. ফা.)।
অন্য একটি হাদিসে এরশাদ হয়েছে “যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে তারাবির নামাজ পড়ল ইমাম প্রস্থান করা পর্যন্ত; তার কিয়ামে লাইল (রাত জাগার সওয়াব পূর্ণরূপে) লিখিত হবে।” (তিরমিজি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৬১-১৬৯, হাদিস: ৮০৬)।
বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা অভিধানের ৫৯৯ পৃষ্ঠায় ‘তারাবি’ শব্দটির ভুক্তি রয়েছে। অভিধান মতে তারাবি শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে, পদে বিশেষ্য। অর্থ – রমজান মাসব্যাপী এশার নামাজের পর অতিরিক্ত বারো বা কুড়ি রাকাত নামাজ।
এতেকাফ:
এতেকাফ একটি আরবি শব্দ। কুরআনুল কারিমে এতেকাফ শব্দটা আকেফীন* হিসেবে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে- অবস্থান করা, স্থির থাকা বা আবদ্ধ থাকা।
রমজানের আরেক নেয়ামত হলো এতেকাফ। লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করার জন্য এতেকাফ করা সুন্নত। পবিত্র কুরআনের সুরাতুল আম্বিয়ার ৫২ নম্বর আয়াত থেকে [ إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ سورة الأنبياء “যে মুর্তিগুলোর পূজায় তোমরা রত আছ, সেগুলো কি?/“এই মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজারি (এতেকাফকারী) হয়ে তোমরা বসে আছ” ? ] এবং আরবি আভিধানমতে এতেকাফের অর্থ হল কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরা এবং তাতে নিজেকে আবদ্ধ রাখা (রত থাকা, মগ্ন থাকা, লিপ্ত থাকা); সে জিনিস ভালো হোক অথবা মন্দ হোক।
শরীয়তের পরিভাষায় বিশেষ নিয়তে বিশেষ অবস্থায় আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনা ও আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।
সকল জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন মিডিয়ায় প্রমিত ‘এতেকাফ’ শব্দের ব্যবহার নির্বাসিত। কিন্তু মনে রাখুন,
ইতিকাফ, ইতেকাফ, এতেকাফ,ইত্তেকাফ লেখার প্রচলন থাকলেও বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা অভিধান মতে শুদ্ধ বানান হবে ‘এতেকাফ’। অভিধানের ২৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘এতেকাফ’ একটি আরবি শব্দ, পদে বিশেষ্য। অর্থ- ইবাদত বা উপাসনার উদ্দেশ্যে রমজান মাসের শেষভাগে নির্দিষ্ট কালের জন্য মসজিদে অবস্থিতি।
এতেকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘মসজিদে এতেকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসুল (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এতেকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর বিবিরাসহ সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করেছেন।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : ২/৪২)
এতেকাফ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, (আর আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে অঙ্গীকারবদ্ধ করলাম যে,) তোমরা উভয়ে আমার (কাবা) গৃহকে তাওয়াফকারী (তায়েফীন), এতেকাফকারী (আকেফীন)*, রুকু (রাকেয়ীন) ও সেজদা (ছাজেদীন) কারীদের জন্য পবিত্র রাখ। (কুরআন: সুরা বাকারা/আয়াত ১২৫)
একই সুরার অন্যত্র এরশাদ হয়েছে,
وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ. سورة البقرة ১৮৭
“আর তোমরা মসজিদে এতেকাফ কালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না।” ( সূরা বাকারা : ১৮৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসংখ্য হাদিসে এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবি (সাঃ) তাঁর ইন্তেকাল অবধি রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করে গেছেন; তার পরে তার স্ত্রীগণ ও এতেকাফ করেছেন। (বুখারী-১/২৭১, মুসলিম ১১৭২)
‘এতেকাফকারী সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত থাকে এবং তার আমলনামায় এতো বেশি নেকি লেখা হয় যেন সে নিজে সব নেক কাজ করেছে’ (মেশকাত শরিফ: ১/১৮৩)।
সংকলক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক।