বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের শপথবাক্য পাঠ

নিজস্ব প্রতিবেদক, এস এম শাহনূর – আখাউড়া ডট কম
বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর উৎসবমুখর ছিল পুরো দেশ। সেদিন জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ শিরোনামে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ। সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। বিকাল পৌনে ৫টায় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে শপথবাক্য পাঠ করান। এতে সারা দেশের সব জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে একযোগে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ শপথ পাঠ করেন। অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এ চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে সব বিভাগ/জেলা/উপজেলা স্টেডিয়াম/মহান বিজয় দিবসের নির্ধারিত ভেন্যুতে শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী বিভাগীয় স্টেডিয়াম থেকে ভিডিও কনফারেন্সে মূল অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে শপথ নেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশের অন্যান্য স্থানের সবাই সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান অনুসরণ করে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের শপথবাক্য পাঠ

শপথবাক্য পাঠ করানোর আগে দেওয়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুসহ ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আজ ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দীর্ঘ ২৪ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।’

‘১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙালি জাতি পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করবে এটা পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালিদের ওপর শুরু করে নিপীড়ন-নির্যাতন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকতে বলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতি জেলা, মহকুমা, থানা, গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশের জনগণ তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।‘

আরও পড়ুনঃ বিজয়নগর উপজেলার নামকরণের ইতিকথা

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে আক্রমণ করে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু সে রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন: ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও। সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ শত্রুটিকে বাংলার মাটি হতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’

‘২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে সমগ্র দেশে পাঠানো হয়। আগে থেকেই ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলী তার তিনজন সহকর্মীসহ সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন।’

‘বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা বাংলাদেশের সব পুলিশ স্টেশন অর্থাৎ থানায় প্রেরণ করা হয়। থানায় কর্মরত অফিসাররা তা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের হাতে ভোর রাতে পৌঁছে দেন। একইসঙ্গে টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারেও এ বার্তা সমগ্র দেশে পৌঁছে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পায়ে হেঁটে, মুখে চোঙ্গা ফুঁকিয়ে বা রিকশায় করে মাইক দিয়ে জেলা থেকে থানা পর্যন্ত সেই বার্তা প্রচার করেন। প্রচারপত্র তৈরি করে বিলি করেন। ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম পাঠ করেন। এরপর একে একে অন্য নেতারা এই ঘোষণা পাঠ করতে থাকেন।‘

‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রিকায় প্রচারিত হয়। বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাশে দাঁড়ায় প্রতিবেশী ভারত, রাশিয়াসহ অন্য বন্ধুপ্রতীম দেশ ও সেসব দেশের জনগণ। মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে আমরা পরাজিত করি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের বিজয়।’

দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, আসুন আমরা বাংলাদেশের বিজয়ের এই সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে শপথ গ্রহণ করি যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবো, বিশ্বসভায় উন্নত-সমৃদ্ধ বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে চলবো। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা এখন শপথ গ্রহণ করবো। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমি এখন শপথ বাক্য পাঠ করবো। আপনাদের আমার সঙ্গে কণ্ঠ মিলানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পাঠকৃত শপথবাক্য:
‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তা।

আজ বিজয় দিবসে দৃপ্তকণ্ঠে শপথ করছি যে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না- দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তুলবো।

মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঠকৃত শপথবাক্যের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন এবং প্রতিটি প্যারা বাঙালি জাতিকে নতুনমন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে, এতে জনজীবনে কর্ম ও চিন্তা শক্তিতে এক নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে সাড়ে সাতকোটি বাঙালি স্বাধীকার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পাঠকৃত উক্ত শপথ বাক্যও ১৭ কোটি মানুষের মনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নাড়া দিয়েছেন। ২০২১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের শপথবাক্য পাঠ সমগ্র বাঙালিকে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জাতী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার মত চেতনা দিবে।

শপথবাক্যের মধ্যে মোট ৩ টি অংশ রয়েছে। প্রতিটি অংশ একই শপথের অংশ হলেও ভাবগত অর্থ ভিন্ন। এতে সর্বমোট ৭২টি শব্দ, ৫টি লাইন ও ৩টি প্যারা রয়েছে।

শপথবাক্যের প্রথম অংশে,
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯মাস এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক এক রাষ্ট্রের জন্মবৃত্তান্তের রক্তাক্ত ইতিহাস বিধৃত হয়েছে।

শপথবাক্যের দ্বিতীয় অংশে,
বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলতে দেশবাসীকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উন্নত-সমৃদ্ধ ও অসম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তোলার শপথ করানো হয়। মানব জীবনকে অর্থবহ করে তুলার কিছু গুণাবলির কথাও বলা হয়।
পাশাপাশি এই লক্ষ্য অর্জনে সবাইকে দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করার কথাও বলা হয়েছে।

শপথবাক্যের তৃতীয় ও শেষ অংশে,
সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা হয়।

লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও গবেষক।

Related Posts

About The Author

Add Comment